চরের জীবন পরের হাতে, তবুও ছন্দ থাকে

2 hours ago 1
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

নদীপাড়ের পলিথিনের ঘর যেন বাতাসের ঢেউয়ে উড়ে যায়। শীতল রাত তাদের হাড় কাঁপিয়ে দেয়। তবুও তারা ভাবেন, ‘এই ভিটে বাবার, এই ভিটে আমার, এই ভিটে হবে সন্তানের। যতই কষ্ট হোক—ভিটে ছাড়া যাবে না। আমি না থাকি—ভিটে টিকুক। বড় কোনো বিপদ এলে মরবো, তবু ভিটে ছাড়ব না।’ দ্বীপ-চরের বাসিন্দাদের চিন্তাগুলো এমনই। মায়ায় বাধা পারিবারিক সন্ধি আর প্রকৃতিকে ঘিরে রচিত হয় চরবাসীর জীবন্ত জীবনী। ঝড়-বন্যার মতো কঠিন অবস্থায়ও নিজের কুঁড়েঘরেই তাদের দিনযাপন। এর নাম বন্ধন, একে বলে শেকড়প্রীতি। তাই তো চরের ঘরে স্বাচ্ছন্দ্য মেলে। চরে মানুষে মানুষে থাকে আন্তরিকতা—মেলবন্ধন।

চরের জীবন পরের হাতে, তবুও ছন্দ থাকে

চর এলাকা বলতেই যারা বোঝেন—কেবল জমি দখল নিয়ে লাঠালাঠি-মারামারি। তাদের জন্য বলা, একবার ঘুরতে যেতে পারেন চর নামীয় এলাকাগুলোয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, অতিথি পরায়ণতা, সরল মানসিকতার মানুষ দেখে ভালো লাগবে উপকূলীয় অধিকাংশ চরাঞ্চলে। উপকূলীয় জেলা খুলনার দুবলার চর; বরগুনার মাঝের চর, ছৈলার চর, পাথরঘাটার লালদিয়ার চর, তালতলীর ফাতরার চর, নিদ্রার চর; পটুয়াখালীর গলাচিপার চরকাজল, রাঙ্গাবালির চর মোন্তাজ, আন্ডারচর; ভোলার চরফ্যাশন, চর কুকরি-মুকরি, মনপুরা, ঢালচরসহ আরও আছে।

প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় চর হলো সাগর, হ্রদ বা নদী বেষ্টিত স্থলভাগ। সাধারণত নদী-সমুদ্রে পলি জমাট বাঁধতে বাঁধতে যে স্থল গড়ে ওঠে, তাকে চর বলে। অর্থাৎ চরের বৈশিষ্ট্য হলো—এর সৈকতভাগ বিপুল পলিমাটি-কাদাবেষ্টিত থাকে, দ্বীপের মতো বালু বা পাথরের সৈকত থাকে না। ফলে বোঝাই যায়, চর সৃষ্টি হয় প্রকৃতির হাতে। প্রকৃতিসৃষ্ট চরগুলোয় মানুষ বসতিও গড়েছে কোনো না কোনো প্রাকৃতিক উপযোগ সংগ্রহের তাগিদে।

চরের জীবন পরের হাতে, তবুও ছন্দ থাকে

বাংলাদেশের চরাঞ্চলের জনপদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, চরগুলোতে মানুষের বসতি বহু পুরোনো। প্রাচীনকাল থেকেই কৃষিকাজ, মাছ আহরণ, গো-চারণ, কাঠ আহরণের মতো নানাবিধ গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রয়োজনে চরগুলোয় মানুষ বসতি স্থাপন করেছে। সে ক্ষেত্রে বলাই চলে, প্রকৃতির দান চর, সে চরের প্রকৃতিকেই ভোগ করতেই মানুষের বসবাস। হয়তো এ কারণেই প্রকৃতির মতো চরের মানুষের মনেও জন্ম নেয় অকৃত্রিম উদারতা।

চরবাসীর মুখে একটি বাক্য প্রায়ই শোনা যায়—‘চরের জীবন পরের হাতে’। এর মানে হচ্ছে—চরের বাসিন্দাদের নিজের জীবনকে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা নিজের হাতে থাকে না। এরা সবাই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্যই চরের কেউ নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবেন না। অসুস্থতায় তারা অন্যের সহায়তায় চান-পান। চরে পরের সহায়তা ছাড়া চলার ক্ষমতা রাখেন না কেউই। এই বিশ্বাস চরবাসীকে এক পরম আত্মীয়তার বাঁধনে রাখে। একে অন্যের প্রতি আন্তরিক হতে শেখায়। বয়োজ্যেষ্ঠকে মান্য করতে শেখায়। সরল হতে শেখায়। লোভী না হয়ে ভালো জীবনব্যবস্থা শেখায়। অল্প চাহিদায় স্বল্প ভোগে জীবনকে বাঁচাতে শেখায়।

চরবাসী প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট বিপদও এদের নিত্যসঙ্গী। তবুও চরাঞ্চলের একেকটি গ্রাম যেন একেকটি হলরুম। বিশেষ একদিনের আয়োজন নয়, বহু কাঙ্ক্ষিত করমর্দন নয়, চরের প্রতিটি দিনই যেন আত্মীয়তার আয়োজন। বিশেষ কোনো কারণ না থাকুক, বিশেষ কোনো আয়োজন না থাকুক, বিশেষ কোনো প্রয়োজন না থাকুক—তবুও বিশেষ বন্ধন থাকে চরবাসীর জীবনে।

কর্পোরেট জীবনের ছোঁয়া এখানে লাগে না। তারা সরল পেশায় অভ্যস্ত। কেউ কৃষক, কেউ খামারি, কেউ জেলে। আবার কেউ দিনমজুর, কেউ কাঠুরে, কেউ গোয়ালে, কেউ দোকানি, কেউ দর্জি। খুব বেশি আইন আদালতের ঝামেলাও তাদের থাকে না। একটু-আধটু সমস্যা সৃষ্টিতে স্থানীয় সমাধানেই যথেষ্ট। চেয়ারম্যান- মেম্বর, স্কুলের হেডমাস্টার আর দু-চারজন গণ্যমান্য বসেই সমাধানের পথ খোঁজেন। এককথায় বলা চলে— অল্প কিছুকে জটিল না করে সহজ সমাধানে মেলে চরের সমীকরণ।

চর অঞ্চলের মানুষ বেশ অতিথিপরায়ণ। নিজে না খেয়ে থাকলেও অতিথি আপ্যায়নে তারা মোটেই কমতি রাখেন না। যতটা সম্ভব সমাদর করেন। প্রকৃতি তাদের উদার হতে শিখেয়েছে প্রকৃতির মতোই। তাই তো উদার প্রাণে সামর্থ অনুযায়ী অতিথি আপ্যায়নের আয়োজন করা হয়। ন্যূনতম চাহিদা পূরণ হলেই তারা খুশি। তাদের নিজেদের খাদ্যাভ্যাস খুবই সাদাসিধে। প্রতিদিনকার তালিকায় থাকে মাছ আর সবজি। অতিথি এলেই এসবের সঙ্গে যোগ হয় মুরগি, গরুর দুধ আর খেজুরের গুড়।

চরের জীবন পরের হাতে, তবুও ছন্দ থাকে

চরের অধিকাংশ মানুষ সরল। এমনই একজন ভোলার ঢালচরের হাতেম আলী। পেশায় সবজি বিক্রেতা। কথা প্রসঙ্গে চরের জীবনযাত্রা নিয়ে বলছিলেন তিনি। জাগো নিউজকে বলেন, ‘চরের মানুষ ঘাম ঝরানো কষ্ট করে নিশ্চিন্তে একটু ঘুমাতে। চরের মানুষ কম চায়, কম পায়, দরকার হলে কম খায়, তবু মেরে-ধরে-ঠকিয়ে খেতে চায় না। এজন্যই ঝড়-বন্যার মত বড় বিপদেও সৃষ্টিকর্তাই চরবাসীকে রক্ষা করেন।’

চরের গ্রাম্য ডাক্তার শরীফ মিয়া বলেন, ‘এই যে চরগুলোয় ভালো চিকিৎসা-চিকিৎসক নেই। তবুও মানুষ খুব বেশি রোগাক্রান্ত নয়। দেশে করোনা এলো—অগণিত মানুষের মৃত্যু হলো, কিন্তু চরগুলোয় কতজন মরলেন? নেহায়েত হাতেগোনা। প্রকৃতির ওপর যারা ভরসা করেন, তাদের প্রকৃতিই রক্ষা করে। চরের মানুষ সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখে, সৃষ্টিকর্তার গুণগান করে। তাই সৃষ্টিকর্তাই তাদের রক্ষা করে।’

এক সন্ধ্যায় পটুয়াখালী জেলার রাঙাবালি উপজেলার চরমোন্তাজের বাধঘাট বাজারে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে আড্ডায় বসেছিলেন স্থানীয়রা। কথা ওঠে সেখানকার জীবনযাত্রা প্রসঙ্গে। জড়ো হওয়া অনেকেই অনেক কথা বলছিলেন। এর মধ্যে কেউ কেউ বলে ওঠেন—দেশের চরগুলোর কৃষকেরা যদি ন্যায্যমূল্য পেতেন, নদী-সমুদ্রের আহরিত মাছগুলো যদি সরাসরি সহজেই শহরের হাটগুলোতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা থাকত, চরের ভাঙন রোধে যদি শক্ত পোক্ত বেড়িবাঁধ থাকতো, তাহলে চরবাসীর চেয়ে শান্তিতে হয়তো দেশের আর কেউ থাকতো না। তারা বলছিলেন, ‘শান্তির জন্য ভালো ঘর লাগে না, লাগে ভালো প্রকৃতি। যা চরগুলোয় ঠিকই মেলে।

এসইউ/জিকেএস

Read Entire Article