ছেলেসহ জামায়াত আমিরের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ

1 day ago 1
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

জবানবন্দির তথ্যে ছেলেসহ জঙ্গি মামলায় আসামি হন জামায়াত আমির
অভিযোগপত্রে চারজন অভিযুক্ত, সাতজনকে অব্যাহতি
সিটিটিসির অভিযোগপত্র আগামী ১৩ মে আদালতে উপস্থাপন
রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতেই এ মামলা: অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক

২০২২ সালের ১ নভেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর এক আসামি সেজাদুল ইসলাম সাহাব তানিম (২৪) ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। তার দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে আসে জামায়াতের ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, তার ছেলে ডা. রাফাত সাদিক সাইফুল্লাহ ও সিলেট জামায়াতের শুরা সদস্য আব্দুল বাসেতের ছেলে আরিফের নাম।

এরপর ওই বছরের ৯ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের ছেলে ডা. রাফাত সাদিককে। যাত্রাবাড়ী থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এ মামলায় কয়েক দফা রিমান্ডে নেওয়া হয় রাফাতকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় ডা. শফিকুর রহমানকে।

সে সময়ে মামলার রিমান্ড আবেদন সংক্রান্ত নথিতে বলা হয়, রাফাত সাদিক জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সিলেট অঞ্চলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সেখানে জিহাদি দাওয়াতের কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার হওয়া তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদকালে রাফাতের নাম বেরিয়ে আসে।

এরপর ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর তাদের গ্রেফতার দেখানো মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে সংস্থাটির তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান দাবি করেন, জামায়াতের আমিরের ছেলে ডা. রাফাতের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জানতেন তার বাবা। তবু বিষয়টি তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে না জানিয়ে অপরাধ করেছেন।

পরে দীর্ঘদিন কারাভোগ শেষে এ মামলায় জামিনে কারামুক্ত হন জামায়াতের আমির ও তার ছেলে।

এ মামলার তদন্ত শেষে গত ৬ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিটিটিসির পুলিশ পরিদর্শক মো. আবুল বাসার। আগামী ১৩ মে আদালতে এই অভিযোগপত্র উপস্থাপন করা হবে।

আগে জামায়াত আমির ও তার ছেলের নামে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ করা হলেও অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান ও তার ছেলে ডা. রাফাত সাদিকের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২ নভেম্বর সিটিটিসির পুলিশ পরিদর্শক মো. মোদাচ্ছের কায়সার বাদী হয়ে ১০ জনকে আসামি করে যাত্রাবাড়ী থানায় এ মামলা করেন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য হিসেবে জঙ্গি কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৮/৯/১০/১২/১৩ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগপত্রে চারজনকে আসামি করা হয়। তারা হলেন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার খশিরবন্দ হাটিটিলার সেজাদুল ইসলাম সাহাব তানিম ওরফে ইসা ওরফে আরাফাত ওরফে আনোয়ার ওরফে আনবির (২৪), কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের মো. জাহিদ হাসান ভূঁইয়া (২১), সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের সৈয়দ রিয়াজ আহমদ (২২) ও সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার গংগাজল গ্রামের মামুনুর রশিদকে (৩৩)। এর মধ্যে মামুনুর রশিদ পলাতক। বাকিরা এ মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন।

জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও তার ছেলে ডা. রাফাত সাদিক এবং অন্য আসামি আরিফ ফাহিম সিদ্দিকীকে অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি। সঠিক নাম-পরিচয় ও ঠিকানা সংগ্রহ করতে না পারায় আসামি তায়েফ, মিজু, আঞ্জুম ও হোসাইনকে অব্যাহতির সুপারিশ।

অন্যদিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান (৬৫) ও তার ছেলে ডা. রাফাত সাদিক (২৯) এবং অন্য আসামি আরিফ ফাহিম সিদ্দিকীকে (২২) অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সঠিক নাম-পরিচয় ও ঠিকানা সংগ্রহ করতে না পারায় আসামি তায়েফ, মিজু, আঞ্জুম ও হোসাইনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। তবে পরবর্তীসময়ে এসব আসামির নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা গেলে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে উল্লেখ করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

অভিযোগপত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আবুল বাসার উল্লেখ করেন, মামলার এজাহারনামীয় আসামিরা সবাই পূর্বপরিচিত। সেই সময়ে এজাহারনামীয় গ্রেফতার আসামি সেজাদুল ইসলাম সাহাব তানিম ও তার বন্ধু তাহিয়াত অন্য আসামিদের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য সহযোগিতার জন্য প্রস্তাব দেন। তাদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে এজাহারনামীয় আসামিরা তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য রাজি হয়। কিন্তু তদন্তকালে প্রকাশ পায় যে, সেজাদুল ইসলাম সাহাব তানিম ও তাহিয়াতদের মূল উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গি সংগঠন আরএসএ ও আরএসওর (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) সঙ্গে যোগাযোগ করে আরাকান রাজ্যের সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে জিহাদে যোগদান করা।

সেজাদুল ইসলাম সাহাব তানিম ও তাহিয়াত তাদের মূল উদ্দেশ্য সবার কাছে গোপন রেখে তাদের নিয়ে ২০২১ সালের ১৮ জুন নাইক্ষ্যছড়ি এলাকায় যান। এ সময় ডা. রাফাত, আরিফসহ অন্য সদস্যরা তানিম ও তাহিয়াতের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন। তখন ডা. রাফাত তার বাবা শফিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে তার বাবা সেখান থেকে নিরাপদে বাসায় আসার ব্যবস্থা করেন। তানিম ও তাহিয়াত নাইক্ষ্যংছড়িতে অবস্থান করে আরএসএ ও আরএসওর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। পরে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে তারা সিলেটে বাড়ি ফিরে আসেন। কিছুদিন পর তাহিয়াত জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে হিজরত করেন। তদন্তকালে একাধিকবার চেষ্টা করে এবং সোর্স নিয়োগ করেও তাহিয়াতের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য এ মামলায় আসামি করা হয়েছিল। তবে তদন্তে তারা নির্দোষ প্রামাণিত হয়েছেন। এ থেকেই স্পষ্ট হয় যে, মূলত চরিত্র হনন করার জন্যই তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছিল।- ডা. শফিকুর রহমান ও তার ছেলের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক

অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা আবুল বাসার উল্লেখ করেন, গ্রেফতারের পর এজাহারনামীয় আসামি সেজাদুল ইসলাম সাহাব তানিম আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তার জবানবন্দিতে জামায়াতে ইসলামের আমির ডা. শফিকুর রহমানের ছেলে ডা. রাফাত ও সিলেট জামায়াতের শুরা সদস্য আব্দুল বাসেতের ছেলে আরিফের নাম প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তদন্তকালে এ মামলার ঘটনার সঙ্গে এজাহারনামীয় গ্রেফতার আসামি রাফাত সাদিক সাইফুল্লাহ ওরফে ডা. রাফাত চৌধুরী ও আরিফ ফাহিম সিদ্দিকী ওরফে আরিফের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া উক্ত সংগঠনের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড মামুনুর রশিদের সঙ্গে অনলাইন বা অফলাইনে ডা. রাফাত, আরিফ ও ডা. শফিকুর রহমানের যোগাযোগ বা সাংগঠনিক সম্পর্কের কোনো প্রমাণ তদন্তকালে মেলেনি।

এ মামলার এজাহারে বলা হয়, গোয়েন্দা নজরদারি ও প্রযুক্তির সহায়তায় জানা যায় যে, উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশের কতিপয় হিজরতকারী সদস্য ঢাকা শহরে নাশকতার পরিকল্পনা করার উদ্দেশ্যে একত্রিত হবে। ২০২২ সালের ১ নভেম্বর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, আনসার আল ইসলামের কতিপয় হিজরতকারী সদস্য ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানাধীন সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল সংলগ্ন হুজুরবাড়ির গেটে নাশকতার পরিকল্পনা করার লক্ষ্যে একত্রিত হবে। উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে সেদিন বিকেল সাড়ে ৫টায় হুজুরবাড়ির গেটের উদ্দেশে রওয়ানা করেন সিটিটিসির সদস্যরা। এরপর সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে হুজুরবাড়ির গেটের আশপাশ এলাকায় অবস্থান নেন তারা। পরে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে হুজুরবাড়ির গেটে মায়ের দোয়া স্টোরের সামনের রাস্তার ওপর সন্দেহভাজন পাঁচজনকে একত্রিত হয়ে আলাপ-আলোচনারত অবস্থায় দেখতে পেয়ে অগ্রসর হয় পুলিশ। এসময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টাকালে সেজাদুল ইসলাম সাহাব তানিম, জাহিদ হাসান ভুইয়া ও সৈয়দ রিয়াজ আহমেদকে আটক করা হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা অন্য দুজন পালিয়ে যান। গ্রেফতারদের কাছ থেকে তিনটি মোবাইল ফোন ও জিহাদি চেতনায় উদ্বুদ্ধকারী বই উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতাররা জিজ্ঞাসাবাদে নিজেদের আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশের সক্রিয় সদস্য বলে জানান।

এদিকে অভিযোগপত্রে অব্যাহতি পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও তার ছেলে ডা. রাফাত সাদিকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক জাগো নিউজকে বলেন, তাদের রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য এ মামলায় আসামি করা হয়েছিল। তবে তদন্তে তারা নির্দোষ প্রামাণিত হয়েছেন। এ থেকেই স্পষ্ট যে, মূলত চরিত্র হনন করার জন্যই তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

এমআইএন/এমএমএআর/এমএস

Read Entire Article