ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS
দেশের বাজারে সোনায় বিরাজ করছে রেকর্ড দাম। ভালো মানের এক ভরি সোনার গহনা কিনতে ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার (ভ্যাট-মজুরিসহ) বেশি। দাম অস্বাভাবিক হওয়ায় সোনার গহনা বিক্রিতে পড়েছে ভাটা। অনেক ব্যবসায়ী লোকবল কমাতে বাধ্য হয়েছেন। ঈদের পর বেশকিছু জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান বন্ধে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, দেশের সোনার বাজারের অবস্থা এখন টালমাটাল। হু হু করে দাম বাড়ায় ছোট-বড় সব ধরনের জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান মারাত্মক ক্রেতা সংকটে। আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষেও সোনার গহনার বিক্রি নেই বললেই চলে। অন্য বছরের তুলনায় বিক্রি কমেছে ৭০ শতাংশের বেশি।
ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, বিশ্ববাজারে সোনার অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণেই দেশের বাজারে পণ্যটির দাম বাড়ছে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বর্তমানে এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। এই অস্থিতিশীলতার কারণেই সোনার দাম বাড়ছে। কারণ, অনেক দেশ নিরাপদ হিসেবে সোনা রিজার্ভ হিসেবে রাখছে।
ছোট একটা আংটি ৪০ হাজার টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। ৪০ হাজার টাকা যে আংটির দাম চাওয়া হচ্ছে তা খুবই পাতলা। এত পাতলা আংটি উপহার হিসেবে দেওয়া যায় না। এর চেয়ে ২০-৩০ হাজার ক্যাশ টাকা উপহার দেওয়া ভালো।-ক্রেতা সোহেলী আক্তার
কয়েক বছর আগেও দেশে এক ভরি সোনা ৫০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া গেছে। সে সময় নতুন শিশুর জন্ম, বিয়ে, জন্মদিন, মুসলমানি, শিশুর মুখে ভাত- এমন শুভদিনে নিকটাত্মীয়দের সোনার অলংকার উপহার দেওয়া একপ্রকার রীতি ছিল। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। দুই আনা দিয়ে একটি আংটি বানাতে গেলেও এখন ৩০ হাজার টাকার মতো লাগছে। এর চেয়ে ২০-২৫ হাজার টাকা নগদ দিলে অনেকেই খুশি হন। ফলে এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সোনার অলংকার উপহার দেওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এমন মত দেন অনেক ব্যবসায়ী।
- আরও পড়ুন
প্রতি সপ্তাহে বাড়ে সোনার দাম, ঈদেও গহনা বিক্রিতে ভাটা
নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঈদ বাণিজ্য
বিশ্ব বাজারে সোনার দাম আরও বাড়লো
সোনার দামে নতুন রেকর্ড, ভরি ১৫৪৯৪৫ টাকা
রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলের জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে ক্রেতা-দর্শনার্থী নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনেক প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মীরা অলস সময় পার করছেন। ফলে জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মীদের মুখেও নেই হাসি। অনেকেই চাকরি হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন।
দেশের বাজারে সোনার দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। সবশেষ গত ১৯ মার্চ দেশের বাজারে সোনার নতুন দাম নির্ধারণ করেছে সোনা ব্যবসায়ীদের এ সংগঠনটি। বর্তমানে এ দামেই দেশের বাজারে সোনা বিক্রি হচ্ছে।
আমাদের বিক্রি পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এখন সোনার গহনার যে দাম, মানুষ কেনা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। আগে নিকটাত্ময়ীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সোনার গহনা উপহার হিসেবে দেওয়া হতো। এখন সেটা খুব একটা নেই। কারণ, দুই আনার একটি আংটি কিনতে গেলে ৩০ হাজার টাকার মতো লাগে।- বাজুসের সাবেক সভাপতি ওয়াদুদ ভূইয়া
বর্তমানে সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৪৫ টাকা, ২১ ক্যারেট ১ লাখ ৪৭ হাজার ৯০০ টাকা। এছাড়া ১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৭৬ টাকা। আর সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনা বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৪ হাজার ৪৯৮ টাকায়।
সোনার এই দামের সঙ্গে ৫ শতাংশ ভ্যাট ও ন্যূনতম ৬ শতাংশ মজুরি যোগ করে সোনার অলংকার বিক্রির নিয়ম করা হয়েছে। এতে ভালো মানের এক ভরি সোনার গহনায় ভ্যাট পড়ে ৭ হাজার ৭৪৭ টাকা। আর মজুরি ৯ হাজার ২৯৭ টাকা। ফলে ভালো মানের এক ভরি সোনার গহনা কিনতে ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৯৮৯ টাকা।
বায়তুল মোকাররম মার্কেটে একটি সোনার আংটি কিনতে এসেছিলেন সোহেলী আক্তার। কয়েক দোকান ঘুরে এক সময় হতাশ হয়ে আংটি না কিনেই ফিরে যান তিনি। একটি দোকান থেকে বের হওয়ার সময় তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার একমাত্র ননদের ছেলের মুসলমানি। তাই একটা আংটি উপহার দেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু ছোট একটা আংটি ৪০ হাজার টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। ৪০ হাজার টাকা যে আংটির দাম চাওয়া হচ্ছে তা খুবই পাতলা। এত পাতলা আংটি উপহার হিসেবে দেওয়া যায় না। তাই না কিনেই ফিরে যাচ্ছি। এর চেয়ে ২০-৩০ হাজার ক্যাশ টাকা উপহার দেওয়া ভালো।’
মার্কেটের একটি দোকানের বিক্রয়কর্মী মো. খায়রুল হোসেন বলেন, ‘সোনার গহনার বিক্রি একেবারেই নেই। আমরা দোকান খুলে বসে থাকি, ক্রেতা আসে না। মাঝে মধ্যে দু-একজন এলেও বিক্রি হয় না। বেশিরভাগ ঘুরে ঘুরে না কিনে ফিরে যায়। আমরা খুবই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আছি। অনেকের চাকরি না থাকার শঙ্কায় দিন কাটছে। ব্যবসা না হলে মালিক তো আর আমাদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবে না।’
গত বছর আমাদের যে বিক্রি ছিল এবছর তার ৩০ শতাংশও নেই। অর্থাৎ, বিক্রি ৭০ শতাংশের ওপরে কমে গেছে। ছোট-বড় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিক্রি এভাবে কমেছে। বিক্রি না থাকায় অনেকেই কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইতোমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।- বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান
বাজুসের সাবেক সভাপতি ওয়াদুদ ভূইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের বিক্রি পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এখন সোনার গহনার যে দাম, মানুষ কেনা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। আগে নিকটাত্ময়ীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সোনার গহনা উপহার হিসেবে দেওয়া হতো। এখন সেটা খুব একটা নেই। কারণ, দুই আনার একটি আংটি কিনতে গেলে ৩০ হাজার টাকার মতো লাগে। আবার এই দুই আনার আংটি খুব একটা মজবুত হয় না। এরচেয়ে ২০-২৫ হাজার টাকা নগদ দিলে মানুষ বেশি খুশি হয়।’
তিনি বলেন, ‘সোনার দাম বাড়া আমাদের হাতে নেই। এটা সম্পূর্ণ বৈশ্বিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ববাজারে সোনার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ফলে দেশের বাজারেও সোনার দাম বেড়েছে। আর অতিরিক্ত দাম হওয়ার কারণে মানুষ কেনা কমিয়ে দিয়েছে। ছোট-বড় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে বিক্রি কমে গেছে। বিক্রি না থাকায় অনেকেই কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন। আর মাত্র কয়েকদিন পর ঈদ। কিন্তু এখনো জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রেতা নেই। আমরা আশঙ্কা করছি ঈদের পর অনেক জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।’
বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভূ-রাজনীতি, যুদ্ধ পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে বিশ্ববাজারে সোনার দাম বেড়েছে। অনিশ্চয়তার কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ রিজার্ভ হিসেবে সোনা মজুত করছে। বিশ্ববাজারে সোনার দাম বাড়ার কারণে আমাদের দেশেও বেড়েছে।’
দাম বাড়ার কারণে আপনাদের ব্যবসায় কী ধরনের প্রভাব পড়েছে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। গত বছর আমাদের যে বিক্রি ছিল এবছর তার ৩০ শতাংশও নেই। অর্থাৎ, বিক্রি ৭০ শতাংশের ওপরে কমে গেছে। ছোট-বড় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিক্রি এভাবে কমেছে। বিক্রি না থাকায় অনেকেই কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইতোমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘টিকে থাকার মতো অবস্থা না থাকলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া তো উপায় থাকবে না। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য একটা বড় সমস্যা হবে। ব্যবসা চালিয়ে রাখতে পারলে সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স পাবে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে তো পাবে না। সুতরাং, প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া আমাদের জন্য ক্ষতি এবং দেশের জন্য ক্ষতি। অনেকের কাজ হারাতে হবে। আমরা আশা করছি আগামী বাজেটে সরকার সুন্দর পলিসি দেবে। যদি ভ্যাটের হার কমানো হয়, আমদানির কাঠামো যদি পরিবর্তন হয়, তাহলে হয়তো সোনার ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে পারে।’
এমএএস/এএসএ/জেআইএম