ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS
কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়গুলো ‘অপহরণ বাণিজ্য’র নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর ‘মহামারি আকারে’ দেখা দিয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়। পাহাড়ের পাদদেশের ফসলি জমি কিংবা পাহাড়ে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক বা খেলারত শিশু এবং মসজিদে যাওয়ার সময়ও অপহরণের শিকার হচ্ছেন স্থানীয় ও রোহিঙ্গারা।
মুক্তিপণ দিতে না পারলে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে অপহৃতদের। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতিতে একের পর এক অপহরণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। ক্রমে এ ঘটনা বাড়লেও স্থায়ী কোন সমাধান মিলছে না।
ভয়ংকর সব পদ্ধতি অবলম্বনে মুক্তিপণ আদায় করছে চক্রটি। সবশেষ উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘরের কাছে খেলারত মুহাম্মদ আরাকান (৭) নামের এক শিশু অপহরণের শিকার হয়। অপহরণের পর তার গলা পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে ভিডিও কলে বাবার কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। চক্রটি সাত লাখ টাকা দাবি করে। পরে দুই লাখ ১০ হাজার টাকা পাঠালে অপহরণের এক সপ্তাহ পর ১৫ জানুয়ারি সকালে জীবিত ঘরে ফেরে শিশুটি। গত ৮ জানুয়ারি দুপুরের দিকে খেলার সময় তাকে অপহরণ করা হয়েছিল।
আরাকানের বাবা আব্দুর রহমান উখিয়ার থাইংখালি ক্যাম্প-১৯ ব্লক সি-১৫ এর বাসিন্দা। ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, ৮ জানুয়ারি দুপুরের পর ঘরের বাইরে আরাকান খেলছিল। হঠাৎ তিনজন নাশতা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে কৌশলে অটোরিকশায় তুলে নেন। পরে অনেক জায়গায় খুঁজেও সন্ধান পাননি। অপহরণ চক্র পরে কল করে সাত লাখ টাকা দাবি করে।
আব্দুর রহমান বলেন, ‘তারা পাষাণের মতো আমার সন্তানকে মাটিতে গলা পর্যন্ত পুঁতে ভিডিও করে তা আমাদের কাছে পাঠায়। সন্তানের বিপদ দেখে মায়ের নাকফুল বিক্রি ও বিভিন্নজনের থেকে ধারদেনায় দুই লাখ ১০ হাজার টাকা তাদের দেখানো মতো স্থানে পাঠানো হয়। টাকা পেয়ে ছেলেকে হাত-পা বেঁধে কুতুপালং বাজারের পাশে ফেলে যায়।’
গত ১৩ জানুয়ারি প্রতিদিনের মতো মসজিদে ফজরের নামাজে যাওয়ার পথে অপহরণের শিকার হন টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের মিনাবাজার ঘোনাপাড়ার বাসিন্দা শাকের আহমদ (৬০)। নামাজ শেষ হলেও বাড়ি না ফেরায় স্বজনরা সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাননি। রাতে নিখোঁজের স্ত্রীর নম্বরে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ফোন করে অপহরণের কথা জানান এবং ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়। ৩২ ঘণ্টার মাথায় ১৪ জানুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে তাকে ছেড়ে দেয়।
তবে এজন্য মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছে কি না তা বলতে রাজি হননি ভুক্তভোগীর ছেলে আব্দুল্লাহ। উদ্ধারের পর বাবাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিপণ পেতে অপহরণকারীরা তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালান।
৫ ডিসেম্বর টেকনাফ ঘুরতে এসে টমটম চালকের সহায়তায় অপহরণের শিকার হন রাঙ্গামাটির বাসিন্দা উলাচি মারমা। আবাসিক হোটেলে নিতে বলার পর রওয়ানা দিয়ে পথে তার সবকিছু ছিনিয়ে নেন। ওই চালকের সঙ্গে আরও তিন যুবক ছিলেন। তারা বড় অংকের টাকা দাবি করে পেতে ব্যর্থ হয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করেন। পরে মুক্তিপণ হিসেবে মালয়েশিয়া পাচার করতে এক বাড়িতে জড়ো করেন। গত ১৪ ডিসেম্বর সেখান থেকে আরও ২৮ জনের সঙ্গে তাকে সাইফুল নামের এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
সম্প্রতি একদিনের ব্যবধানে দুই সিএনজিচালকসহ আরও ৯ জন অপহরণের শিকার হন। এর আগে টেকনাফ বন বিভাগের পাহাড়ে কাজ করতে গিয়ে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়সহ ১৯ জন শ্রমিককে অপহরণ করা হয়। তিন দিনে ২৮ জন অপহরণ হলে পুলিশ, র্যাব ও এপিবিএন যৌথ অভিযান চালায়। কিন্তু দুর্গম এলাকা হওয়ায় কাউকে উদ্ধার করা যায়নি। পরে সবাই কমবেশি মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসেন।
এসব ঘটনার পর রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কৃষক এবং বিভিন্ন পেশার লোকজন কাজে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। ভয়ে রাতে ক্যাম্পে থাকেন না রোহিঙ্গা মাঝিরাও (নেতা)। অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করায় সন্ত্রাসীদের আটক করতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিয়ানমারের কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় কিছু ডাকাতচক্র মিলে এসব অপহরণ বাণিজ্য করছে। এসবের সঙ্গে শতাধিক রোহিঙ্গা ও স্থানীয় ডাকাতরা জড়িত। তাদের হাতে রয়েছে ভারী অস্ত্র। এদের সঙ্গে রয়েছে মানব পাচারকারীদের যোগসূত্র। তারা বিদেশি পিস্তল, ইয়াবার হাতবদল ঘটাচ্ছেন। ব্যবহার করছেন উন্নত প্রযুক্তি। এভাবে হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, ধর্ষণ, মানবপাচার ও চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপে পাহাড়কে ‘অপরাধের স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত করেছে চক্রটি।
টেকনাফের বাহারছড়া, হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও টেকনাফ সদর ইউনিয়ন, উখিয়ার থাইংখালী, বালুখালী, কুতুপালং, লম্বাশিয়াসহ প্রায় ক্যাম্প পাহাড়বেষ্টিত। আর দুর্গম পাহাড়ে আস্তানা গড়েছে ডজনেরও অধিক স্থানীয় ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর হতেই বেড়ে যায় অপহরণ। শিশু, শিক্ষার্থী, রিকশাচালক, মাছ ব্যবসায়ী, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ সবাই অপহরণের শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে সবাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে সন্ধ্যার পর সন্তানদের ঘরের বাইরে যেতে দেন না। অনেকে সন্তানদের বিশেষ পাহারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘অপহরণ দলের সদস্যরা দিনে ছদ্মবেশে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কাকে অপহরণ করলে বেশি টাকা পাওয়া যাবে, সেটা জানার চেষ্টা করেন। পরে সেভাবে প্ল্যান করে অপহরণের ঘটনা ঘটায়।’
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘হোয়াইক্যংয়ের কম্বনিয়াপাড়া, মহেশখালিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, সাতঘরিয়াপাড়া, রইক্ষং এলাকার অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার অপহরণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অতীতে এসব গ্রাম থেকে অপহরণের পর চারজন হত্যার শিকার হয়েছেন।’
কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্য বলছে, টেকনাফের বাহারছড়া, শামলাপুর, জাহাজপুরা, হ্নীলা, লেদা, মুছনি, রইক্ষং, জাদিমুড়া, হোয়াইক্যং, বালুখালী, থাইংখালী, কুতুপালংসহ আশপাশের এলাকায় প্রায়ই অপহরণের ঘটনা ঘটছে। গত দেড় বছরে টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে দুই শতাধিক ব্যক্তি অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে অর্ধেক রোহিঙ্গা। এসময় অন্তত আড়াই কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করেছে চক্রটি।
টেকনাফ থানার তথ্যমতে, ২০২৪ সালে অপহরণের মামলা হয়েছে ২০টি। এসব মামলায় উদ্ধার হয়েছেন ৫৭ জন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ৪২টি অপহরণ মামলায় ৮১ ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়েছে। আসামির সংখ্যা প্রায় ৭০। গ্রেফতার হন ২০ জন। মানবপাচার আইনের সাত মামলায় ১৬৮ জন ভিকটিম উদ্ধার এবং ১৬ আসামি গ্রেফতার হন।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘টাকার লোভে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী অপহরণ বাণিজ্যে নেমেছে। স্থানীয় অপরাধীদের সহায়তায় তারা এসব করছে। অপহরণ করে মুক্তিপণ না পেলে মালয়েশিয়ায় পাচারচক্রের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। এরইমধ্যে অনেককে আটক ও ভিকটিমদের উদ্ধারে আমরা সক্ষম হয়েছি। বাকিদের ধরতে অভিযান চলমান।’
জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, অপহরণের পর দুর্গম পাহাড়েই ঢুকে পড়েন অপহরণকারীরা। পুলিশের সেখানে একক অভিযান চালানোর মতো সরঞ্জাম নেই। তাই আমরা যৌথ অভিযান চালাতে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছি। আশা করছি, খুব শিগগির আমরা একটি সফল চিরুনি অভিযান চালাতে পারবো।
কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, দুর্গম পাহাড়ে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি সফল অভিযানে অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। অপরাধীদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, পাহাড়ে অপহরণ এবং মানবপাচার বন্ধে প্রশাসনের সব সেক্টর যৌথভাবে কাজ করার উদ্যোগ চলছে। পাহাড়বেষ্টিত বিভিন্ন এলাকায় সিসি ক্যামেরা ও পুলিশের চৌকি স্থাপনের কথাও হয়েছে।
এসআর/জেআইএম