ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS
প্রতিবছর শীতকালে কয়েকবার শৈত্যপ্রবাহ হয় । তখন কোথাও সারাদিন সূর্যের দেখা মেলে না। কোথাও রাতভর বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝড়তে থাকে। এর সাথে কনকনে ঠান্ডা বাতাসে শরীর জমে যায়। অতিবয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। কারো কারো হাত পা কোঁকড়া লেগে শরীর অবশ হয়ে যায়। যাদের উপযুক্ত গরম কাপড় নেই তারা একটু উষ্ণতা পাওয়ার জন্য আগুন পোহানোর ব্যবস্থা করেন।
কনকনে এ সময় গ্রামের অধিকাংশ মানুষ শুকনো পাতা, গোবরের ঘসি, খড়কুটায় আগুন দিয়ে পোড়ের আগুন জ্বালিয়ে অধবা রান্নার চুলার পাশে বসে তাপ নিয়ে শীত নিবারণ করতে চেষ্টা করেন। শহরাঞ্চলের দরিদ্র ও ভাসমান মানুষেরা কাগজ, ঠোঙ্গা, পলিথিনের ব্যাগ, সাইকেল-গাড়ির টায়ার ইত্যাদিতে আগুন দিয়ে একটু উষ্ণতা পাওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ বাসার গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রেখে ঘর গরম রাখেন।আগুন পোহানোর এসকল ধরনের কৌশল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায়শই: শরীরের কাপড়ের সাথে আগুন লেগে পুড়ে আহত বা নিহত হবার ঘটনা ঘটে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতিবয়স্ক ও শিশুদের প্রাণহানির খবর শোনা যায়।
গতবছর শীতের শুরুতে মাত্র তিনদিনেই আগুন পোহানোর কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে দুজনসহ সারাদেশে বহু মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন এবং হাসপাতালে দগ্ধ রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। তবে এটা যেন এবছর আর না ঘটে সেজন্য সবাইকে সতর্কতার সাথে পোড়ের পাশে বসতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কগণ যাতে পোড়ের আগুন তাপানো পোহানো থেকে বিরত থাকেন সেজন্য তাদেরকে পর্যাপ্ত গরম কাপড় ও গরম পানীয় ও খাবার সরবরাহ করতে হবে। শৈত্য প্রবাহের আগাম সংবাদ গ্রামে—গঞ্জে মাইকিং করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতি বছর শীত এলেই কিছু মানুষ নানা সংগঠনের নামে শীতার্তদের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদা তুলে থাকেন। সেসব অর্থ থেকে যৎসামান্য শীতার্তদের জন্য ব্যয় করা হয়। সেটাও ঘটে বড় বড় শহরের আশে-পাশে। একই স্পটে সব ব্যক্তি বা সংস্থা বা সরকারি লোকজন কম্বল বণ্টন করতে যান। ফলে শহরের একজন দরিদ্র বা বস্তিবাসী একাই অনেকগুলো ত্রাণের কম্বল বা অর্থ পেয়ে যান। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে— একজন ব্যক্তি বারংবার হাত পেতে বিভিন্নজনের নিকট থেকে অনেকগুলো কম্বল পেয়েছেন। সেগুলো বাজারে নিয়ে গিয়ে পুনরায় ঐ কম্বলের দোকানে স্বল্পদামে বিক্রয় করে দিয়েছেন ! এতে দেখা যায়— গ্রামের হতদরিদ্র, শীতার্ত মানুষ কিছুই পাচ্ছে না অথচ শহরের দরিদ্র একই মানুষ দশ—বারটি কম্বল পান !
এর আরেকটি কারণ হলো- অতি শীতের সময় দিনের পরিধি ছোট হওয়ায় অনেকে দিনমজুর ডাকেন না। দিন ছোট ও ঠান্ডায় কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিনে আনে দিন খাওয়া মানুষেরা চরম অভাবের সম্মুখীন হয়ে পড়েন। তারা কোথাও রিলিফ বা শীতবস্ত্র পাওয়া যেতে পারে সেই আশায় ছুটে যান।তারা বেশী শীতবস্ত্র বা কম্বল সংগ্রহ করতে পারলে সেগুলো বিক্রি করে ক্ষুন্নিবৃত্তির চেষ্টাও করে থাকেন। তাই শীতবস্ত্রের পাশাপাশি শীতে কর্মহারা দিনমজুর ও অতি দরিদ্রদের জন্য নগদ অর্থ ও খাবার সরবরাহ করা উচিত।
তাই শুধু শহরের বস্তি ও পার্কে নয়, গরম কাপড় নিয়ে আজই চলুন বণ্টন করতে দূর গাঁও—গেরামে যেখানে অজস্র অশীতিপর শীতার্ত মানুষ এই কনকনে শীতে একটু উষ্ণতার পরশ পাওয়ার আশায় আঁকুপাকু করছে। তারা অভিযোগ করছেন, সামনে নির্বাচন আসছে। তাই এবছর শীতের শুরু থেকেই কম্বল বিতরণ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। যে বছর নিবার্চন নেই সেবছর নেতাদের চেহারা দেখাও বন্ধ থাকে। তখন আমাদের খবর নিতে এখন কেউ আসে না!
যাহোক, এবছর বিভিন্ন সরকারি তরফ থেকে শীতবস্ত্রের নামে শুধু কম্বল বিতরণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ‘চলতি শীত মৌসুমে শীতার্ত ও দুঃস্থদের মাঝে বিতরণের জন্য ৬ লাখ ৭৯ হাজার কম্বল কিনতে ৩৩ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার’।জানুয়ারীর শুরু থেকে উত্তরাঞ্চলের ১৩টি জেলায় ইতোমধ্যে কনকনে শীত নেমেছে। সাথে বিভিন্ন উপজেলা দপ্তর থেকে নিজস্ব উদ্যোগে কিছু কম্বল বিতরণের পর সেগুলো অপ্রতুল প্রতীয়মান হওয়ায় জেলা বরাবরে কম্বলের চাহিদাপত্র পাঠানো শুরু হয়েছে।
এছাড়া প্রতিবছরের মতো এবছরও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, এনজিও, এনপিও, বিজিবি, টিভিকেন্দ্র, ধর্মীয় দানশীল সংগঠন ঢাকা ও বড় বড় শহরের মধ্যে অথবা আনাচে কানাচে শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু করেছেন। এসব কিছুই খুব ভালো উদ্যোগ।তারাও শীতবস্ত্র দেওয়ার পাশাপাশি শীতের কারণে বেকার দিনমজুর ও অতি দরিদ্রদের জন্য নগদ টাকা ও খাবার প্রদান করলে ভাল কাজ হতে পারে।
কিন্তু প্রকৃত নিড অ্যাসেসমেন্ট কেউই করছেন না। কারো সাথে অন্যকারো যোগাযোগ ও সমন্বয় নেই। দান ও ত্রাণ নিয়ে শহরের সবাই একই স্থানে যেতে থাকেন। বন্যার সময়ও এমনটি হতে দেখা যায়।শীতের সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ জানতেই পারে না কম্বলের কথা।অথচ শহরতলির কেউ কেউ একাই বা এক পরিবারেই অনেকগুলো কম্বল পেয়ে যান! বিগত দিনগুলোর মতো এবারের শীতেও যেন কম্বল বণ্টনে এ ধরনের অনিয়ম বা এলাকাভিত্তিক বৈষম্য সৃষ্টি না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
বিগত বছরগুলোতে তার প্রমাণ দেখা যেত নিকটস্থ কম্বলের দোকানে বা ফুটপাতে। সেখানে সেগুলো ব্যবহৃত বা সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্য হিসেবে কমদামে বিক্রি হয়ে যেত। কিছু অসাধু দোকানী সেগুলো সস্তায় কিনে আবার তাদের দোকানে চড়া দামে বিক্রি করেন। প্রকৃত দোকানীরা অভিযোগ করেন এমন ঘটনার।
আমাদের দেশে মানুষে মানুষে চরম আয় বৈষম্য থাকার কারণে ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। উন্নত দেশগুলোতে শহুরে মানুষেরা প্রতিবছর নিজেদের পুরোনো জিনিস, কাপড় ইত্যাদি স্বল্পমূল্যের খোলা বাজারে (ফ্লি—মার্কেট), পার্কে বা গ্যারাজ সেলে রেখে দেয়। স্বল্প আয়ের মানুষেরা সেগুলো পানির দামে অথবা বিনামূল্যে সংগ্রহ করে। আমাদের ধনী পরিবারগুলোর আলমারিতে যুগ যুগ ধরে অব্যবহৃত পুরোনো দ্রব্য, কাপড় ইত্যাদি থাকলেও কখনও গরিবের জন্য হৃদয় গলে না।
তাই সমাজের সামর্থ্যবানদেরকে আহ্বান করবো নিজেদের অপ্রয়োজনীয় অব্যবহৃত কাপড়—সামগ্রীগুলো মানব কল্যাণে পুনর্ব্যবহারের (রি—সাইকেল) জন্য বিতরণ করুন। এজন্য নিকটস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্কাউট, রোভার—রেঞ্জার, বিএনসিসি ইউনিটগুলোকে টেলিফোন করে আপনার নিকট থেকে সংগ্রহ করতে উৎসাহিত করুন। তারা নিজ দায়িত্বে গ্রামের গরীব দুখিদের নিকট সেগুলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে। এভাবে আমরা সবাই শীতের প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করতে পারি এবং শীতের ঠান্ডা নিবারণে আগুন পোহানোর সমূহ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য গ্রামের গরীব দুখিদের সহায়তা করে অনেক মূল্যবান জীবন রক্ষা করতে পারি।
পাশাপাশি যে কোনো রিলিফ বা দানকৃত সামগ্রী বণ্টনের পূর্বে সরকারি বেসরকারি সাহায্যদাতাগণের উচিত অতিদ্রুত সাহায্যপ্রার্থীদের সংখ্যা ও প্রকৃত অবস্থা যাচাই করে একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে সঠিকক্ষেত্র বিশেষে দান বা সাহায্য করা। যাতে সকল এলাকার শীতকাতর দুস্থ মানুষ শীতবস্ত্রের নাগাল পায়।অসম ও অদূরদর্শী বন্টনের ফলে কেউ বার বার বা একাই ১০টি কম্বল পাবে, দোকানে বা ফুটপাতে গিয়ে পুনরায় বিক্রি করে দেবে- আর কেউ কিছুই পাবেনা তা হতে দেয়া উচিত নয়।
এতে সম্পদের অপচয় রোধ হবে এবং সামাজিক বঞ্চনা অনেকাংশে কমে গিয়ে সামাজিক ভাঙন রোধ করা ত্বরান্বিত হবে। এভাবে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে একাই নেব, একাই পাব, একাই খাব নীতির অবসান করে মৌল-মানবিক চাহিদা পূরণ ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/এমএস