আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণ এবং বিদেশি ক্রেতা অন্বেষণ

6 hours ago 2
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

বন্ধু-বান্ধব এবং পরিচিত পরিমণ্ডলে যারা রপ্তানি বাণিজ্যে সম্পৃক্ত হতে চান তারা সবাই প্রায়শই একটি কমন প্রশ্ন করেন যে বিদেশি ক্রেতা কীভাবে অন্বেষণ করা যায় বা অনেকেই রপ্তানি করার জন্য সরাসরি সম্ভাব্য ক্রেতাদের ডাটাবেজও চেয়ে থাকেন। নবীন উদ্যোক্তা এবং নতুন রপ্তানিকারক যারা রপ্তানি বাণিজ্যে ইতোমধ্যে সফল হয়েছেন তারা নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত হবেন, বিষয়টি একেবারে সহজ নয়। পরিকল্পনামাফিক একটি দীর্ঘ পথপরিক্রমা অতিক্রম করে ব্যবসায়ীরা এ সফলতা অর্জন করেন। আমি প্রকৃতপক্ষে নবীন উদ্যোক্তা বা রপ্তানিকারক হতে আগ্রহী তাদের উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করার অভিপ্রায়ে আমার পেশাগত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং পারদর্শিতা এখানে ব্যক্ত করার সুযোগ নিচ্ছি।

রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছে বিদেশি ক্রেতা অন্বেষণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আইকনিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। মেলার সাইডলাইন ইভেন্ট হিসেবে অনুষ্ঠিত ম্যাচ ম্যাকিং, বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সেমিনার এবং নেটওয়ার্কিং সেশনও সম্ভাব্য বিদেশি অন্বেষণের উল্লেখযোগ্য প্ল্যাটফর্ম। মেলায় অংশগ্রহণের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের গভীরে প্রবেশের আগে মেলার শ্রেশিবিভাগ বিষয়ে একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন।

আমরা সাধারণত মেলার প্রকৃতি/বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় একে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করতে পারি। যেমন – ১. সোর্সিং মেলা, ২. কনজ্যুমার মেলা, ৩. একক দেশীয় বাণিজ্য মেলা, ৪. থিম্যাটিক মেলা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সোর্সিং মেলাসমূহে মূলত Potential Buyer অন্বেষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত রপ্তানিকারকরা অংশগ্রহণ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত এসব পণ্যভিত্তিক বিশেষায়িত মেলায় বিশ্বের খ্যাতনামা ও স্বীকৃত রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সাথে দেশের প্রতিষ্ঠিত রপ্তানিকারকরা খাতসংশ্লিষ্ট দেশের নতুন বাজার সৃষ্টির এবং বিদ্যমান বাজার অধিকতর সুসংহত করার লক্ষ্যে অংশগ্রহণ করে।

প্রতিটি বিনিয়োগের যথাযথ ফলাফল পেতে মেলা চলাকালীন সম্ভাব্য ক্রেতা এবং কন্টাক্ট পয়েন্ট অন্বেষণের জন্য সর্বোচ্চ মনোনিবেশের কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় পারদর্শী এমন Profession Sales Promoter নিয়োগ করেও Buyer Hunting করা যেতে পারে।

এসব মেলায় পণ্যের Authentic Supply Source অন্বেষণের জন্য Global Reputed Brand, Hypermarket, Wholesaler এবং Retailer এর উপযুক্ত প্রতিনিধিরা সম্ভাব্য ক্রেতা/ভিজিটর হিসেবে অংশগ্রহণ করে। ফলে সম্ভাব্য ক্রেতা খোঁজার জন্য সোর্সিং মেলা অন্যতম Marketing Weapon বিশেষভাবে সমাদৃত।

উল্লেখ্য, সোর্সিং মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ (Exhibitor) তাদের অনুকূলে বরাদ্দ করা স্টল/বুথে তাদের উৎকৃষ্ট এবং গুণগত মানসস্পন্ন পণ্যগুলো ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য প্রদর্শন করে। এখানে খুচরা বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। কনজ্যুমার মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ পণ্য প্রদর্শনের পাশাপাশি খুচরা বিক্রির সুযোগ পেয়ে থাকে। এ শ্রেণির মেলায় End-User-রা সাধারণত তাদের পছন্দ মতো পণ্য ক্রয়ের জন্য পরিদর্শন করে। নবীন উদ্যোক্তারা এ শ্রেণির মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিদেশি বাজার সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা পেতে সক্ষম হোন, যা পরে সোর্সিং মেলায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তার আত্মবিশ্বাসকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

এবার মেলার যে শ্রেণি সম্পর্কে ধারণা প্রদান করব তা রপ্তানিকারক এবং যে সব রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চান তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ এসব মেলার মাধ্যমে একটি দেশের রপ্তানি সম্ভাবনা ও সামর্থ্য, বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও সুযোগ, পর্যটন শিল্পসহ দেশের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি কে সম্ভাব্য বিদেশি ক্রেতা এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে উপস্থাপনের প্রয়াস নেওয়া হয়। বাণিজ্য সম্ভাবনাময় দেশসমূহে সরকারের ট্রেড প্রমোশন সংস্থার উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় এ ধরনের ইভেন্ট আয়োজন করা হয়।

এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ের ইভেন্ট আয়োজকও সরকারি ট্রেড প্রমোশন সংস্থার সহায়তায় এ ধরনের একক দেশীয় পণ্য প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বাংলাদেশ এ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ (Bangladesh Apparel Exchange) “Best of Bangladesh” শিরোনামে ইউরোপে নিয়মিতভাবে এ ধরনের ইভেন্টের আয়োজন করছে। দেশকে ইতিবাচকভাবে ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে নতুন বিদেশি ক্রেতা অন্বেষণ এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য এ ধরনের ইভেন্ট অত্যন্ত কার্যকর বিপণন সরঞ্জাম ( Marketing Tools)।

পাঁচ বছর অন্তর আয়োজিত World Expo এবং দুই বছর অন্তর আয়োজিত Specialized Expo থিম্যাটিক প্রদর্শনীর আওতাভুক্ত। প্যারিসভিত্তিক Bureau International des Expositions (BIE) (আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজিত প্রদর্শনীসমূহের নিয়ন্ত্রক সংস্থা) এর সদস্যভুক্ত দেশসমূহের ভোটাভুটির মাধ্যমে এ সব প্রদর্শনীর আয়োজক দেশ নির্বাচন করা হয়। আয়োজক প্রতিষ্ঠান হওয়ার বিষয়টি Prestigious হওয়ায় প্রতিযোগী দেশসমূহ ভেন্যু আয়োজক হওয়ার জন্য তীব্র ভোটযুদ্ধে লিপ্ত হয়। থিম্যাটিক প্রদর্শনী থিমভিত্তিক এবং অংশগ্রহণকারী দেশসমূহ মূল থিমের অধীন বিভাজিত সাব-থিম জোনে অংশগ্রহণ করে। World Expo 2025 আগামী ১৩ এপ্রিল ২০২৫ থেকে ১৩ অক্টোবর ২০২৫ সময়ে জাপানের ওসাকায় অনুষ্ঠিত হবে ।

ওই প্রদর্শনীর মূল থিম "Designing Future Society for Our Lives",-এর অধীন তিনটি সাব-থিম রয়েছে , Saving Lives, Empowering Lives, and Connecting Lives। বাংলাদেশ Connecting Lives সাব-থিমের অধীন অংশগ্রহণ করবে। এসব প্রদর্শনীতে জাতীয় প্যাভিলিয়নের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস, কৃষ্টি-কালচার, হ্যারিটেজ, অবকাঠামো, নব-উদ্ভাবন, প্রযুক্তি, বিশ্ব মানবতার কল্যাণে গৃহীত উদ্যোগ, ভবিষ্যৎ উদ্ভাবন, অর্থনীতি, টেকসই উন্নয়ন এবং পর্যটন শিল্পকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দর্শনার্থীদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। এ ছাড়া বিদেশি ক্রেতা অন্বেষণের অংশ হিসেবে বিভিন্ন বি-টু-বি এবং ম্যাচ ম্যাকিং সভারও আয়োজন করা হয়।

বোঝার সুবিধার্থে মেলায় অংশগ্রহণ সংক্রান্ত কার্যসমূহকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ১. মেলাপূর্ব কার্যক্রম; ২. মেলা চলাকালীন কার্যক্রম; ৩. মেলা পরবর্তী কার্যক্রম ।

মেলাপূর্ব কার্যক্রম
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথমে আপনার প্রতিষ্ঠানের খাত সংশ্লিষ্ট বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত আইকনিক মেলা সস্পর্কে ধারণা নিতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট সোর্সিং মেলা আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত বা যথার্থ কি না তা সংশ্লিষ্ট মেলার Website ভিজিটপূর্বক মেলার Organizer Profile (আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাইকরণ), Exhibitor Profile (অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান এবং কোন খাতের পণ্য প্রদর্শিত হয় সে সম্পর্কে ধারণা), Visitor Profile (সম্ভাব্য ক্রেতা সম্পর্কে ধারণা) এবং Post Report (

গত বছর অনুষ্ঠিত মেলার আউটকাম সম্পর্কে অবহিত হওয়া) ইত্যাদি Review করে জানা যায়। বিবেচ্য বিষয় পর্যালোচনা করে সন্তোষজনক মনে হলে মেলায় অংশগ্রহণের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, মেলায় অংশগ্রহণ করা মানেই নিশ্চিত ক্রেতা আপনি পেয়ে যাচ্ছেন তা কিন্তু নয়। মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান Authentic Contact Point/ Potential Buyers এর সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। পরে এ সম্পর্ক যথাযথ পরিচর্যার (সম্ভাব্য ক্রেতার অনুসন্ধানের প্রাসঙ্গিক জবাবসহ অন্য বিষয়াদির যথাসময় ফিডব্যাক) মাধ্যমে রপ্তানি আদেশ প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। অনেকেরই একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে মেলায় অংশগ্রহণ মানেই নিশ্চিতভাবে ক্রেতা পেয়ে যাওয়া।

কোনো নির্দিষ্ট মেলায় অংশগ্রহণের তথ্য বিশ্লেষণে সন্তোষজনক মনে হলে ওই মেলায় অংশগ্রহণের জন্য বুথ/স্টল অথবা raw space প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য আপনার প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। নিবন্ধনের জন্য নির্দিষ্ট ডেড-লাইন দেওয়া থাকে এবং ডিসকাউন্টে বুথ নেওয়ার জন্য Early Bird Offer সুবিধাও প্রদান করা হয়। মেলার বুথ/স্টল/ খালি জায়গার রেন্ট Payment করার পর আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে আপনার প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয়েছে।

সম্ভাব্য বিদেশি ক্রেতা এবং টার্গেট গ্রুপ যেন আপনার প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্য কোম্পানি প্রোফাইল এবং লোকেশনসহ বুথ নম্বর মেলা আয়োজকের ওয়েবসাইটে (অন-লাইন ক্যাটালগ এন্ট্রি) আপলোড করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। এ ছাড়া শেল-স্কিম (Shell Scheme(বুথ প্যাকেজ) ক্যাটাগরিতে বুথ বরাদ্দ গ্রহণ করলে প্যাকেজবহির্ভূত কোনো সুবিধা (stand facilities)ভাড়ায় গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট টাইমলাইনের মধ্যে মেলা আয়োজককে অবহিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্যথায় যাচিত সেবাসমূহ মেলা আয়োজক হতে পাওয়া যাবে না এবং আপনাকে অধিক ব্যয়ে ওই সুবিধা অন্য কোনো মাধ্যম হতে গ্রহণ করতে হবে। Raw Space নিয়ে নিজস্ব ডিজাইনে প্যাভিলিয়ন/বুথ নির্মাণ করতে হলে আয়োজক প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এক্ষেত্রে আপনার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিযুক্ত Design Developer প্রতিষ্ঠানকে মেলা আয়োজকের কাছে নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেমের মধ্যে stand plan দাখিল করতে হবে। সব দেশেই কোনো ইভেন্ট চলাকালীন সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অনেক আগে থেকেই ট্যুর প্ল্যান করার পাশাপাশি হোটেল বুকিং এবং বিমান টিকিট নিশ্চিত করতে হবে। মেলায় প্রদর্শিত পণ্য প্রেরণের জন্য আগ থেকেই সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে।

এক্ষেত্রে মার্কেট ট্রেন্ড পর্যালোচনা করে উন্নতমানের বুথ/স্টলে পণ্য প্রদর্শনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। কেননা গুণগতমানহীন পণ্য প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার পাশাপাশি দেশের ইমেজও ক্ষুণ্ন করে। ফলে অংশগ্রহণকারীর পক্ষে মেলায় অংশগ্রহণের মূল উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না। লক্ষ্য করা গেছে যে, মেলায় অংশগ্রহণকারী কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে প্রতিনিধিত্বকারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এ ক্ষেত্রে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয়। মেলা ভেন্যুতে পৌঁছে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে প্রেরিত এক্সিবিটগুলো মেলা আয়োজক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিঅ্যান্ডএফ থেকে বুঝে নিতে হয়। এ ব্যতীত মেলা ভেন্যুতে বুথ/স্টল বুঝে নেওয়ার পর বুথের Interior Decoration এবং product showcasing কার্যাদি দ্রুততর সময়ের মধ্যে সম্পাদন করার বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

মেলা চলাকালীন কার্যক্রম

Booth/Stand বরাদ্দ গ্রহণের পর পেশাদারত্বের সাথে বুথ পরিচালনার ওপর নির্ভর করে আপনার সফল হওয়ার বিষয়টি। মেলা চলাকালীন অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানকে নিম্নরূপ বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা একান্ত আবশ্যক:

১. অভ্যন্তরীণ সজ্জা এবং ব্র্যান্ডিং: বুথ/স্টলে দর্শনার্থীর দৃষ্টি কাড়তে হলে এর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা দৃষ্টিনন্দন হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে সম্ভাব্য বিদেশি ক্রেতাদের নিকট catchy word এ প্রতিষ্ঠানের Slogan এবং Unique Selling Proposition(USP) উপস্থাপন করতে হবে। বুথের অভ্যন্তরে এলইডি স্ক্রিন ব্যবহারের করে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যবস্থা এবং কমপ্লায়েন্স প্রতিপালনকারী ইস্যুসমূহ অডিও ভিজ্যুয়াল এর মাধ্যমে প্রচার করা যেতে পারে। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ বুথের অভ্যন্তরীণ সজ্জা এবং ব্র্যান্ডিংয়ের বিষয়ে চরমভাবে উদাসীন, যা তাদের অংশগ্রহণের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে ।

২. পণ্য প্রদর্শন (Product Showcasing): আপনার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উৎপাদিত বিশ্বমানের গুণগতমানসস্পন্ন পণ্য বুথের দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। দৃষ্টিগ্রাহ্য স্থানে আকর্ষণীয় পণ্য প্রদর্শন একটি আর্ট। ফলে মেলায় আগত সম্ভাব্য ক্রেতা এবং দর্শনার্থী আপনার বুথে প্রদর্শিত পণ্যে আকৃষ্ট হয়ে আপনার বুথ পরিদর্শন করবে, যা ক্রেতা অন্বেষণে প্রচেষ্টাকে সহজ করবে। বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ এ বিষয়ে একেবারেই উদাসীন এবং তারা পণ্যসমূহ এমনভাবে টেবিল বা র্যাকে স্তপীকৃতভাবে রাখে যে সম্ভাব্য ক্রেতারা বুথ পরিদর্শনে নিরুৎসাহিত হয়। এ বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের জন্য product showcasing consultant রয়েছে তাদের পরামর্শ নিয়ে পণ্য প্রদর্শন মানসম্পন্ন ভাবে করা যেতে পারে।

৩. দর্শনার্থী/সম্ভাব্য ক্রেতাদের বিষয়ে মনোযোগ প্রদান : মনে রাখতে হবে সোর্সিং মেলায় আগত প্রতিটি দর্শনার্থীই আপনার সম্ভাব্য ক্রেতা। বুথের আশেপাশে এবং সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করা সব দর্শনার্থীকে সম্ভাষণ দিয়ে আপনার বুথে স্বাগত জানান। নিজেকে ল্যাপটপ অথবা মোবাইলে আবিস্ট না রেখে সম্ভাব্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য মনোযোগ প্রদান করা প্রয়োজন। কেননা মেলায় অংশগ্রহণের জন্য আপনি অর্থ, সময় এবং মেধা বিনিয়োগ করেছেন।

প্রতিটি বিনিয়োগের যথাযথ ফলাফল পেতে মেলা চলাকালীন সম্ভাব্য ক্রেতা এবং কন্টাক্ট পয়েন্ট অন্বেষণের জন্য সর্বোচ্চ মনোনিবেশের কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় পারদর্শী এমন Profession Sales Promoter নিয়োগ করেও Buyer Hunting করা যেতে পারে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানকে যিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন সে ব্যক্তিরও পণ্যের প্রোফাইল জ্ঞানসহ কমিউনিকেশন স্কিল কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় থাকা বাঞ্ছনীয় ।

৪. সম্ভাব্য ক্রেতাদের অনুসন্ধানের যথাযথ জবাব : সম্ভাব্য ক্রেতা/দর্শনার্থীরা পণ্যের উপকরণ, কাঁচামালের উৎস, স্থানীয় মূল্য সংযোজন হার, এক্স-ফ্যাক্টরি এবং এফওবি মূল্য, কম্প্লায়েন্স ইস্যু এবং অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা সম্পর্কে অবহিত হতে চান। তাই এসব বিষয়ে সম্যক ও স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করা উচিত। আলোচনার সময় সম্ভাব্য ক্রেতার অনুসন্ধান যথাযথভাবে নোট করা উচিত, যাতে করে যেসব বিষয় উত্তর অজানা থাকে তা পরে ফলোআপের সময় প্রদান করা যায়। সম্ভাব্য ক্রেতার সাথে সু-সম্পর্ক তৈরির জন্য পণ্যের যাবতীয় খুঁটিনাটি সম্পর্কে জ্ঞান এবং পরিপূর্ণ ধারণা থাকা আপনাকে বাড়তি সুবিধা দেবে বললে অত্যুক্তি হবে না।

৫. আপ্যায়ন এবং স্যুভেনির প্রদান: বুথে আগত দর্শনার্থীদের (সম্ভাব্য ক্রেতা) সাথে আলোচনার সময় ড্রাইফুড/কুকিজ/চকলেট এবং চা/কফির মাধ্যমে আপ্যায়িত করা সাধারণ সৌজন্যবোধের পর্যায়ভুক্ত। সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তা অনন্য ভূমিকা পালন করে। দেশীয় পণ্যের মাধ্যমে এ ধরনের সৌজন্যবোধ প্রদর্শন বাড়তিমাত্রা যোগ করে। এছাড়া দেশীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য এর পরিচয় বহন করে এমন ধরনের ছোট হস্তশিল্পজাত পণ্য স্যুভেনির হিসেবে প্রদান করা যেতে পারে ।

৬. সময়ানুবর্তী, ম্যানার এবং এটিকেট : ফরমাল পোশাক পরিধান করে মেলা আয়োজক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে বুথে সময়মতো উপস্থিত থাকা সাধারণ এটিকেটের মধ্যে পরে। মেলায় আগত দর্শনার্থীদের সাথে শিষ্টাচারের সাথে সৌজন্যবোধ দেখানো এবং বিদেশি ক্রেতাকে দেশের সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন আপনার প্রতি দর্শনার্থীর আগ্রহ অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের স্থানীয় অংশগ্রহণকারীরা এসব বিষয়ে মোটেই সচেতন নয়। মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে সময়মতো বুথে উপস্থিত এবং ফরমাল পোশাক পরিধান করে বুথে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রায়শই অমনোযোগী হতে দেখা যায়।

৭. মেলার সাইডলাইন ইভেন্টে অংশগ্রহণ: সোর্সিং মেলা চলাকালীন আয়োজক কর্তৃক সাইড ইভেন্ট হিসেবে খাত সংশ্লিষ্ট কারেন্ট ইস্যুভিত্তিক সেমিনার, ম্যাচ ম্যাকিং/বিটুবি সভা এবং নেটওয়ার্কিং সেশনের আয়োজন করা হয়। ওই ইভেন্টসমূহে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের টার্গেট গ্রুপ যোগদান করে বিধায় খুব সহজেই সম্ভাব্য ক্রেতা এবং বিনিয়োগ পার্টনার খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তাই সম্ভাব্য ক্রেতা অন্বেষণের জন্য মেলার সাথে আয়োজিত আলোচ্য ইভেন্টসমূহে অংশগ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক।

মেলা-উত্তর কার্যক্রম:
মেলা চলাকালীন অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের বুথে এবং মেলার সাইডলাইন ইভেন্ট হিসেবে অনুষ্ঠিত ইভেন্টসমূহে (সেমিনার, ম্যাচ ম্যাকিং/বিটুবি সভা এবং নেটওয়ার্কিং সেশন) সম্ভাব্য ক্রেতার (টার্গেট গ্রুপ) সাথে সাক্ষাৎ এবং কার্যকর সভা করে থাকেন। এসব সভায় সাক্ষাৎ করা প্রতিনিধিদের বিভিন্ন অনুসন্ধানের জবাব মেলা শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রদান করতে হয়। অন্যথায় সম্ভাব্য ক্রেতা হাতছাড়া হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। ফলে মেলা সমাপ্ত হওয়ার পর প্রতিটি অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানকে তাদের (সম্ভাব্য ক্রেতা) অনুসন্ধানের জবাবসমূহ যথাসময়ের মধ্যে প্রদান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানই এ বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেন না। মেলার অংশগ্রহণ সফল করার জন্য অংশগ্রহণকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে মেলা-উত্তর কার্যক্রমের প্রতি সবিশেষ মনোযোগ প্রদান করা উচিত।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণের বিষয়ে সহযোগিতা

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বাজার উন্নয়ন এবং বাজার বহুমুখীকরণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আইকনিক সোর্সিং/কনজ্যুমার শ্রেণির মেলায় অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি রপ্তানি সম্ভাবনাময় দেশে একক দেশীয় বাণিজ্যমেলা আয়োজন করে। এ লক্ষ্যে ব্যুরো বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশন, সরকারী বাণিজ্য সহায়ক সংস্থা এবং বিভিন্ন ট্রেড এসোসিয়েশন থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থবছরভিত্তিক দেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি খাত প্রক্ষেপণ রপ্তানি সম্ভাবনাময় দেশে মেলায় অংশগ্রহণের জন্য একটি বার্ষিক পরিকল্পনা (মেলা ক্যালেন্ডার) প্রণয়ন করে।

আগ্রহী রপ্তানিকারকর উক্ত মেলা ক্যালেন্ডার www.epb.gov.bd পর্যালোচনা করে তাদের খাতের জন্য উপযুক্ত মেলায় অংশগ্রহণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন। ব্যুরোর ব্যবস্থাপনায় মেলায় অংশগ্রহণের জন্য আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন, ইআরসি (রপ্তানি নিবন্ধন সনদ), আয়কর, বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর (বিন), চেম্বার সনদ, পিআরসি (রপ্তানিকারক ইতোমধ্যে রপ্তানি করে থাকলে এর প্রমাণক) ইত্যাদি প্রয়োজন হবে।

নবাগত, স্বনামধন্য এবং প্রতিষ্ঠিত রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে নতুন নতুন বাজার অন্বেষণে সহায়তা এবং দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে বেগবান করার লক্ষ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো মেলায় অংশগ্রহণ ফি’র ওপর প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার ভিত্তিতে বিশেষ ভর্তুকি প্রদান করে । এ ভর্তুকির পরিমাণ ২০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ হয়। তবে নবাগত রপ্তানিকারকের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এ ভর্তুকির পরিমাণ ৬০ শতাংশ। উপযুক্ত নবাগত এবং নারী উদ্যাক্তা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের উৎপাদিত পণ্যের বিশ্ববাজারে রপ্তানি সম্ভাবনা, বিশ্বের চলমান ফ্যাশন ট্রেন্ডের সাথে সামঞ্জস্যতা, উৎপাদন সক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেসের যথার্থতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মেলা ও প্রদর্শনী বিভাগ মেলায় অংশগ্রহণ সংক্রান্ত যাবতীয় সহযোগিতা অংশীজনকে প্রদান করে।

সোর্সিং মেলায় অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ সম্পর্কে এ প্রবন্ধে ধারণা প্রদান করা হয়েছে। অন্য শ্রেণির মেলায়ও অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া একই ধরনের। আমি বিশ্বাস করি কার্যকরভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণের করণীয় বিষয়ে একটি বিশদ এবং স্বচ্ছ ধারণা পাঠকরা পেয়েছেন এবং এ ধারণা যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে রপ্তানি বাণিজ্যে সাফল্য লাভ করতে আগ্রহী উদোক্তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম হবেন।

লেখক: পরিচালক, ইপিবি।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

Read Entire Article