কুপিয়ে হত্যার প্রবণতা কেন বেড়েছে?

14 hours ago 1
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

এই লেখার প্রস্তুতি নিতে নিতেই অন্তত ৪/৫ টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নজরে এলো। দু’ একদিনের মধ্যেই কুপিয়ে হত্যার এতগুলো খবর দেখে মনে হলো যে লেখার জন্য ঠিক ইস্যুই বাছাই করেছি। কেন সমাজে কুপিয়ে হত্যা করার প্রবণতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে? বিশেষভাবে কারা জড়িত এই বিশেষ ধরনের অপরাধের জন্য?

পল্লবীতে বাবু ওরফে ব্লেড বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ গ্রুপ। প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতা এতোদিন কারাগারে ছিল, সম্প্রতি জামিনে বের হয়ে এসেছে। এসেই ব্লেড বাবুকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। একটা গুলি খরচ করলেই ব্লেড বাবুকে হত্যা করা যেতো, কিন্তু তা না করে সন্ত্রাসীরা বেছে নিয়েছে সবার সামনে ‘কুপিয়ে মারার’ পদ্ধতি। এর অর্থ হচ্ছে সন্ত্রাসীরা মানুষের উপস্থিতিকে ভয় পায় না এবং একই সঙ্গে সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইছে তাদের শক্তি কতখানি।

মাত্র কিছুদিন আগে সাভারের হেমায়েতপুরে হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার জেরে ছয়জনকে কুপিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছে জামিনে বের হয়ে আসা আসামিসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এর আগে এলিফেন্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান মার্কেটের জয়েন্ট সেক্রেটারি প্রকাশ্যে কুপিয়ে মারা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন কিছু না কিছু কুপিয়ে হত্যা বা আহত করার খবর থাকছেই। আগে যে এসব হতো না, তা নয়। তবে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন বয়সের এই অপরাধীদের দেখে মনে হয় হামলাকারীরা সবাই যেন কসাই। শুধু পার্থক্য হচ্ছে কসাইদের পেশাই হচ্ছে কেটে-কুটে মাংসকে খাদ্য উপযোগী করা, তারা পশু আর এরা মানুষ কুপিয়ে খুন বা আহত করে।

খুনি অপরাধী চক্র আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠার আগেই তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। এই দিকটায় দৃষ্টি দিতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। যারা গ্যাং তৈরি করে, যারা অপরাধ করায় এদের অনেকেই এখন লুকিয়ে আছে, আছে হাজতে অথবা এখনো সেইভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে হবে। রাজনৈতিক শক্তি ও পরিচয় আবার জোরালো হওয়ার আগেই আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।

বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হচ্ছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। সবধরনের মারামারি, খুনোখুনিতে এরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত অথবা বড় অপরাধীদের সাথে কাজ করছে। কিশোর গ্যাং এখন স্লোগান দেয় যে ‘কিশোর গ্যাং যেখান দিয়ে যায়, কোপাইতে কোপাইতে যায়’। এই স্লোগান শুনে বুঝে নিতে হবে যে আমাদের সমাজ ‘কোপানো-বান্ধব’ সমাজে পরিণত হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের এমন ভয়ংকর স্লোগানে আতঙ্কিত শুধু এলাকাবাসী নয়, আমরা সবাই। ভাবলাম হেলমেট বাহিনী নাই, এবার হয়তো কোপাকুপির রাজনীতি বন্ধ হবে। কিন্তু অবস্থা দিনে দিনে অবনতি হচ্ছে।

১০ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত যত হত্যা, মৃত্যু, হামলা ও সংঘর্ষের খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর একটা চার্ট বানিয়ে আপলোড করেছেন একজন ব্লগার তাঁর ফেসবুকে। ১০ ও ১১ তারিখে হত্যা ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১৫ টি, আর ১২ জানুয়ারি ঘটেছে ৭ টি। অর্থাৎ তিন দিনে মোট ২২ টি। অধিকাংশ মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া পিটিয়ে মারা ও চোখ তুলে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া কাউকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে।

পুলিশের সদর দপ্তর সূত্রই বলছে, গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর দুই মাসে সারা দেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৫২২টি। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরি, দস্যুবৃত্তিসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫৬টি। তবে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে ব্যাপক অবনতি হয়েছে, তা বোঝার জন্য পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না, এমনই বোঝা যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ কোথাও না কোথাও হত্যার ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন ইস্যুতে যত্রতত্র রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। (সূত্র: যুগান্তর)।

গত তিন মাসে শুধু গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন প্রায় ৬৮ জন। ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। এছাড়া রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে দেশীয় অস্ত্র ও লাঠি হাতে হরহামেশাই মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে অপরাধীদের। হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুলিশ প্রশাসনে নানাধরণের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একের পর এক শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ার পেছনে এটি একটি বড় কারণ বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। তাঁরা বলছেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগারে থেকেই ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতো, এখন স্বাধীন হয়ে আবার বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।

যেসব কুখ্যাত সন্ত্রাসী হাজত থেকে এত বছর পরে শহরে এসেছে, তারাতো কেউ বসে নেই। নতুন করে ক্ষমতা দখল ও টাকা আয় করার চেষ্টা করবেই। ইতোমধ্যে জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা পুরোনো রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে ফিরতে চাইছে ও তাদের পুরোনো অপরাধের নেটওয়ার্ক সচল হতে চাইছে।

অপরাধের জগত ফিরে পাওয়ার জন্য এরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মহড়া দেওয়ার পাশাপাশি চাঁদা চেয়ে ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছে। অনেকে অলরেডি হত্যাকাণ্ডে জড়িত হয়েছে। এদের নয়া সঙ্গী হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা, যারা ইতোমধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে অপরাধ জগতে পা রেখেছে। কিশোর গ্যাং এর ক্ষুদে সদস্যরা ক্রমশ দাগী সন্ত্রাসীদের সাথে মিলে অপরাধীদের চক্রকে শক্তিশালী করছে। এরা মূলত নয়া সোর্স হিসেবে কাজ করছে।

এছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এলাকার ‘দখল’ নিতে সন্ত্রাসীরা এখন মারমুখী। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মতিঝিল, মগবাজার, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় এ প্রবণতা বেশি। ডিস-ইন্টারনেট ব্যবসা, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন, ফুটপাত, বাজার, ঝুট ব্যবসা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও নির্মাণকাজ থেকে চাঁদাবাজি এবং জমি দখলের মতো বিভিন্ন খাত থেকে চাঁদা তোলা ও আর্থিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে তারা।

সন্ত্রাসীদের অনেকের হাতে যে অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে, সে কথা অনেকেই বলছেন। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা এখন কতটা শক্তিশালী? পুলিশ আবার সক্রিয় হয়েছে উঠেছে ঠিকই কিন্তু এরপরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেন স্বাভাবিক হচ্ছে না, তা দেখা দরকার। পুলিশের পোশাক বদলের চাইতেও জরুরি, তাদের মনের জোর ফিরিয়ে আনা, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রশিক্ষণ দেয়া, লোকসংখ্যা বাড়ানো। অপরাধীদের নেটওয়ার্ক যতোটা বেড়েছে, এরচাইতে অনেক বেশি জোরালো করতে হবে পুলিশের নেটওয়ার্ক। পুলিশ সংস্কার কমিশন কাজ শুরু করেছে। তারা চেষ্টা করবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করা ও পুলিশের খোলনলচে বদলে একটা শুদ্ধ বাহিনীকে বের করে নিয়ে আসতে।

বিভিন্ন ঘটনায় নগরীতে জনভোগান্তি সৃষ্টি হলেও পুলিশ সেভাবে অ্যাকশনে যাচ্ছে না। ভয়াবহ একটা ট্রমার পর যদি পুলিশের কাউন্সেলিং দরকার হয়, তাহলে দ্রুত কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ অপরাধ দমনে ও অপরাধীকে হাতকড়া পরানোর জন্য অবশ্যই দক্ষ পুলিশ প্রয়োজন। বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও ভাঙচুর ঠেকাতে হলেও পুলিশ দরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি যদি সঠিক হয়, তাহলে যুদ্ধমান পরিস্থিতি বেশি দূর গড়াবে না এবং অপরাধীরাও শক্তি প্রদর্শনের সাহস পাবে না।

শহরের ভেতরে চলাচল করতে গিয়েও অনেকে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছেন। প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতি হাতে পথচারীকে হামলা করার দৃশ্যও আমরা ফেসবুকে দেখতে পারছি। সেখানেও আসামির চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এব্যাপারে কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে বলত শুনিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, "এই ধরনের ঘটনাগুলো আতঙ্ক ছড়ায়। আওয়ামী লীগ এগুলোকে পুঁজি করে অপপ্রচার করে। আমরা তো দেখছি না সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে খুব বেশি ভূমিকা রাখছে। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে গ্রুপ ধরে ধরে গ্রেপ্তার করা।”

কেন মানুষের মধ্যে এই সহিংসতা লক্ষ করা যাচ্ছে? আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাময়িক দুর্বলতা ও পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে কারা এইসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তা খুঁজে বের করতে হবে। এখন কোনো সংঘর্ষ বা গোলযোগ সৃষ্টি হলে সবাই চাপাতি, রাম দা ও বল্লম হাতে এগিয়ে আসছে। সামান্য কথা কাটাকাটি হলেই একজন আরেকজনের ঘাড়ে কোপ বসিয়ে দিতে দ্বিধা করছে না।

খুন বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয় ও রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মধ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব। অনেক নতুন নতুন মুখ এসেছে অপরাধ জগতে- এরা খুন, চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন কারণে নগরজীবনের চাপ সামলাতে মানুষের হিমশিম অবস্থা। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল এবং সেটা বাড়ছে। অনেকেই বেকার হয়ে পড়ছেন, জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় নানারকম চাপে সমাজের একশ্রেণির মানুষ নতুন করে অপরাধে জড়াচ্ছেন। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের একটা অংশ হতাশা থেকে অপরাধ করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজের শিথিলতার কারণেও চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।

অপরাধ বাড়ছে এটা নিয়ে মানুষ যতোটা না চিন্তিত এর চাইতে বড় উদ্বেগ হচ্ছে অপরাধের সাথে কিশোর গ্যাং এর সংশ্লিষ্টতা। এই কিশোর গ্যাং আপনার আমার সন্তান, এদের হাতেই আগামীর বাংলাদেশ। গত কয়েক বছর থেকেই ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, নারীদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপরাধ ঘটলে, সেখানে ‘কিশোর গ্যাং’-এর নাম আসছে। অথচ এক যুগ আগেও পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক অপরাধের ঘটনায় নাম আসতো কোনো না কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর। এখন সে জায়গা ‘দখল’ করেছে কিশোর গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবেও কাজ করছে। ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে, তার ২৫টি কিশোর গ্যাং-সংশ্লিষ্ট (ডিএমপি), এর অর্থ হচ্ছে, বিভিন্ন গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজ এলাকায় প্রভাব বাড়াতে এক পক্ষ আরেক পক্ষের সঙ্গে ভয়ংকর সংঘর্ষে জড়াচ্ছে।

খুনি অপরাধী চক্র আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠার আগেই তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। এই দিকটায় দৃষ্টি দিতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। যারা গ্যাং তৈরি করে, যারা অপরাধ করায় এদের অনেকেই এখন লুকিয়ে আছে, আছে হাজতে অথবা এখনো সেইভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে হবে। রাজনৈতিক শক্তি ও পরিচয় আবার জোরালো হওয়ার আগেই আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।

২১ জানুয়ারি, ২০২৫

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article