ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS
কুড়িগ্রামে ‘ঐতিহাসিক’ এক কৃষক মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে কৃষক ও ভিআইপিদের জন্য প্রস্তাবিত খাবারের বৈষম্যমূলক বরাদ্দের বিষয়ে। চেয়ে টাকা না পাওয়ার তথ্য দিয়ে আয়োজনের আহ্বায়ক বলছেন, এ ধরনের সমালোচনা শিশুসুলভ।
২৬ জানুয়ারি জেলার চিলমারী উপজেলায় অনুষ্ঠেয় এই কর্মসূচিতে যোগদান করা কৃষকদের জন্য একবেলা খাবারের জন্য জনপ্রতি ২০০ টাকা বরাদ্ধ ধরা হলেও ভিআইপিদের জন্য রাখা হয়েছে ৫০০ টাকা। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, কৃষকদের পেট কী আর বড় হবে না?
নাহিদ হাসান নলেজ নামে একজন শিক্ষকের সই করা এ-সম্পর্কিত একটি চিঠি বুধবার থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে খাবারের বরাদ্দ এবং অনুষ্ঠানের ব্যযের একটি ছক রয়েছে। আর তা নিয়ে চলছে তুমুল সমালোচনা। অনেকে জানতে চাইছেন, কে এই নাহিদ হাসান নলেজ, কৃষকদের নিয়ে কী কাজইবা রয়েছে তার।
আরো যেসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগ হলেও সরকারি বরাদ্দ টানার চেষ্টা, আয়োজকরা ১ লাখ কৃষকের সমাবেশ ঘটানোর কথা বলে কেন ৩০ হাজার জনের বরাদ্দ চেয়েছেন।
‘উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন গণকমিটি’ নামে একটি ব্যানারের আহ্বায়ক পরিচয় দিয়ে জেলা প্রশাসককে মাধ্যম করে ব্যয় সংকুলানের টাকা চেয়ে নাহিদ হাসান চিঠিটি পাঠিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর।
তবে আয়োজকরা বলছেন, হাট-ঘাট থেকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির জন্য এই মহাসমাবেশ। এখানে খাবার কোনো বিষয় নয়। সরকারের কাছে একটি সহায্য চাওয়া হয়েছিল, সেটি পেলে ভালো হতো; পাওয়া যায়নি; তবু সমাবেশ হবে নির্ধারিত দিনেই।
চিঠির ভাষায় যা আছে
কথিত আহ্বায়ক নলেজ সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, “বিনীত নিবেদন এই যে, কৃষক-জেলে-তাঁতীরা যুগ-যুগান্তের বঞ্চিত ও ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। তাদের দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে আগামী ২৬ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে উপস্থিত থাকবেন রংপুর, রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের সব জেলার কৃষকরা। আশা রাখি, লক্ষাধিক কৃষক এতে উপস্থিত হবেন।”
“আমরা তাদের মধ্যে মাত্র ৩০ হাজার কৃষককে এক বেলা আহার করাতে ইচ্ছুক। উল্লেখ্য, উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম (বীরপ্রতীক)।”
অর্থ বরাদ্দে জনাবকে (সচিব) আজ্ঞা দেওয়ার নিবেদন করে তার নিচে একটি ছক করে বরাদ্দের ধরন ও টাকার অঙ্ক দিয়েছেন আহ্বায়ক নলেজ। সে অনুযায়ী, ৩০ হাজার কৃষক-জেলের খাবারের জন্য ২০০ টাকা হারে ৬০ লাখ, ভিআইপি ১০০ জনের খাবারের জন্য ৫০০ টাকা হারে ৫০ হাজার এবং স্টেজ, সাউন্ড সিস্টেম, গেট, লাইটিং, বসার ব্যবস্থা, তোরণ এবং আনুষাঙ্কিত অন্যান্য ৫ লাখ টাকার বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে।
অতিথি যারা
আয়োজকরা যে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন, সে অনুযায়ী এই কৃষক সমাবেশে বিশিষ্টজনদের অতিথি করা হয়েছে। বলা হচ্ছিল, সমাবেশ উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
অতিথি হিসেবে আরো যাদের নাম প্রচার করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছেন: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, লেখক ও সংগঠক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খান, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কারাবন্দি নেতা কনক রহমান, জাতীয় নাগরিক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কবি আব্দুল হাই শিকদার, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি আহমেদ ইসহাক।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব মোর্শেদ, লেখক-সংগঠক রাখাল রাহা ও পাভেল পার্থ, বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শেখ নাছির উদ্দিন, কৃষক দেলোয়ার জাহানের নাম আয়োজকদের প্রচারে রয়েছেন।
চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নের জোড়গাছে সফি আলম রাজা স্টেডিয়ামে এই মহাসমাবেশে বিভিন্ন জেলার কৃষকদের জমায়েত ঘটানোর চেষ্টা করছেন আায়োজকরা।
ব্যাপক প্রতিক্রিয়া
ইমতে আহসান শিলু নামে একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক তার ফেসবুক পোস্টে চিঠিটি দিয়ে লিখেছেন, “বৈষম্যহীন রাষ্ট্রে মো. নাহিদ হাসানের আহ্বানে কৃষকের জন্য খাবার বরাদ্দ ২০০ টাকা আর ভিআইপিদের খাবার ৫০০ টাকা!”
ইমতে আহসান শিলুর সঙ্গে কথা হলে রাইজিংবিডি ডটকমকে তিনি বলেন, “এটা কৃষকের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা।”
কুড়িগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক হারুন অর রশিদ তার ফেসবুকে লিখেছেন, “সমাবেশ করবেন আপনারা, খরচের টাকা চেয়ে আবেদন করবেন সরকারের কাছে। এটা কোন ধরনের আবদার।”
নাহিদ হাসান নলেজের সঙ্গে কথা হলে রাইজিংবিডি ডটকমকে তিনি বলেন, “হাট-ঘাটের ইজারা বাতিল, কৃষকদের উৎপাদিত পণের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ও চরের মানুষের নদী ভাঙনের বিষয় নিয়ে একটি ঐতিহাসিক কৃষক সমাবেশের আয়োজন করেছি।”
“এই কৃষক সমাবেশে পাবনার কৃষক, কক্সবাজারের লবণ চাষীসহ সারা দেশ থেকে লোজন আসবেন। আমরা তো সরকারের কাছে আবেদন করতেই পারি। আমরা কৃষকদের একবেলা খাওয়াতে চাই। যদি সরকার দেয়, তো দেবে। এ বিষয়ে আমরা রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছি।”
প্রেক্ষপট ও জেলা প্রশাসকের বক্তব্য
আহ্বায়ক নলেজ বলেন, “আমরা ডিম-খিচুরি খাওয়াইতে চাইছিলাম। কিন্তু সরকারের লোকজনই বলেছে যে, ৬০ টাকা হবে কেন? আপনারা মুরগি দিয়ে খাওয়ান। এতে কৃষকপ্রতি গড়ে ২০০ টাকা করে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। মহাসমাবেশে ৩০ হাজারের অধিক লোক হবে। এই ৩০ হাজার কৃষকের জন্য ৬০ লাখ টাকা লাগছে। তার সঙ্গে ডেকোরেটরের ভাড়া রয়েছে। উপজেলা পরিষদে অতিথিরা খাবেন। সব মিলে ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাজেট দিয়েছি।”
আবেদন করলেও সরকারের কাছ থেকে কোনো টাকা পাননি জানিয়ে নজেল বলেন, “টাকা কি আমরা পেয়েছি? সরকার আমাদের টাকা দিলে দেবে, না দিলে নাই। আবেদন করেছিমাত্র। একটি আবেদন নিয়ে শিশুসুলভ কথাবার্তা আমি হাস্যকর ঘটনা বলে মনে করছি।”
মহাসমাবেশের চিঠি নিয়ে হুলস্থূল শুরু হলে বিষয়টি জানতে রাইজিংবিডি ডটকম কথা বলেছে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানার সঙ্গে। তিনি বলেছেন, “আমাদের কাছে চিঠি আসায় তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। বরাদ্দ দেবে কি দেবে না, সেটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়।”
কে এই আহ্বায়ক নলেজ
নাহিদ হাসান নলেজ চিলমারীর শাখাহাতি ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক; উপজেলার রমনা সরকার বাড়ী গ্রামের বাসিন্দা তিনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি একসময় ‘রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন কমিটি’ নামে একটি সংগঠন করেছিলেন তিনি। কৃষি রক্ষা, কৃষকের অধিকার ও পরিবেশ নিয়ে সচেতন এই মানুষটি নিজের মতো করে অনেক কাজ করে চলেছেন।
কৃষকদের নিয়ে কেন মহাসমাবেশ ঘটাচ্ছেন, জানতে চাইলে নলেজ বলেন, “এই সমাবেশ কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে করা হয়নি। এটা মূলত নিজেদের উদ্যোগে করা। কেউ করতেও বলেনি।”
শিক্ষক নজেলের বাড়ি চিলমারীতে হলেও বর্তমানে তিনি কুড়িগ্রাম জেলা শহরের কলেজপাড়ায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন।
কৃষকদের এই মহাসমাবেশ সমাজের দশজন মিলেই ডাকা হয়েছে জানিয়ে নলেজ বলেন, “কৃষকদের কথা চিন্তা করে করা হয়েছে। তা ছাড়া জমিদার না থাকলেও এখনো জমিদারি প্রথার মতো হাটে-ঘাটে খাজনা তোলা হচ্ছে। এটার প্রতিবাদ করার জন্যই নিজেরা চিন্তা করে ১০ জন মিলে আলোচনা করে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।”
সরকারি সহযোগিতার ওপর সমাবেশটি নির্ভর করছে না, যা তাদের প্রচারপত্র দেখে বোঝা যায়। এটি মূলত জনগণের অর্থায়নের বাস্তবায়নের লক্ষ্য থেকে শুরু করা। প্রচারপত্রে দেখা যায়, সর্বসাধারণের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা চেয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নম্বর দেওয়া হয়েছে। জনগণের স্বার্থে এ ধরনের তহবিল সংগ্রহকে বলা হয় ক্রাউড ফান্ডিং, যার অর্থ মানুষের ছোট ছোট আর্থিক সহায়তা তাদেরই বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য কিছু করা।
‘অতিথিরা না এলেও সমাবেশ হবে’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তারা আসবেন না বলে নিশ্চিত করেছেন কৃষক মহাসমাবেশের এই আহ্বায়ক। নলেজ বলেছেন, “তারা না এলেও সমবাবেশ হবে।”
দুই উপদেষ্টার কুড়িগ্রাম সফর উপলক্ষে বুধবার (২০ জানুয়ারি) জেলা প্রশাসক বরাবর মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি এলেও বৃহস্পতিবার তাদের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারির কুড়িগ্রাম সফর স্থগিত করে জেলা প্রশাসক বরাবর মন্ত্রণালয় থেকে আবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।
তবে উপদেষ্টারা কৃষক সমাবেশে না থাকলেও কর্মসূচি স্থগিত বা বাতিল করা হয়নি। এমনকি সরকারের চেয়েও টাকা না পাওয়াকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না নলেজ। তিনি বলেছেন, “অনুষ্ঠান হবে।”
বৃহস্পতিবারও চিলমারীতে এই কর্মসূচি ঘিরে আয়োজকদের প্রচার-প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে।
সমাবেশ উপলক্ষে তৈরি করা একটি পোস্টারে দেখা গেছে, একপাশে মওলানা ভাষানী ও অন্য পাশে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের ছবি দিয়ে বেশ কিছু কথা লেখা হয়েছে; যা থেকে সমাবেশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা যায়। সেখানে গোবিন্দগঞ্জ-ফুলবাড়িতে সাঁওতাল কৃষকদের নামে মামলা প্রত্যাহারের দাবি রয়েছে। সব মিলে ১২টি দাবি নিয়ে এই মহাসমাবেশ ডাকা হয়েছে।