‘পরিবর্তিত’ বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা কেন কলকাতার বাঙালিদের?

2 hours ago 1
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

‘ছোটবেলা থেকে বাবা-কাকার কাছে ঢাকা আর বাংলাদেশের কত গল্প শুনেছি, বহুবার সে দেশে যাওয়ার কথা ভেবেছি। কিন্তু, না, আর বাংলাদেশে যাব না!’ কথাগুলো বলছিলেন কলকাতার বাসিন্দা এক নারী।

তিনি সরকারি কর্মচারী, তাই নাম প্রকাশ করতে চান না। ওই নারীর কথায়, ‘কোন বাংলাদেশে যাবো? ইতিহাসটাই তো বদলে দেওয়া হচ্ছে সেখানে – কী দেখতে যাবো সে দেশে আর?

এমন মনোভাব কলকাতার মধ্যবিত্ত সাধারণ বাংলাভাষী মানুষের একাংশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে গত আগস্টের পর থেকে।

আবার বাংলাদেশ থেকে যে বহু সংখ্যক মানুষ কলকাতায় আসতেন নানা কারণে, তাদেরও প্রায় কেউই আজকাল আসছেন না। মধ্য কলকাতার নিউ মার্কেট অঞ্চলে ঘুরলেই দেখা যায় সেই চিত্র। এর একটা বড় কারণ অবশ্য মেডিকেল ভিসা ছাড়া বাংলাদেশের নাগরিকদের ভারতের ভিসা প্রায় দেওয়া হচ্ছে না।

তবে গত আগস্টেরই শেষের দিকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন দীর্ঘদিনের প্রবাসী চাকরিজীবন শেষে কলকাতায় এখন অবসর সময় কাটানো রাজা গাঙ্গুলি।

‘জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের ঘটনাবলি দেখে অনেকে আমাকে বারণ করেছিল যেতে। যেন বাংলাদেশে ঢুকলেই ভারতীয় হিন্দু বলে আমাকে কেটে ফেলবে। কিন্তু ঝালকাঠির চেচরি গ্রামে আমার পূর্বপুরুষের জন্মভিটে দেখার স্বাদ মেটানোর সুযোগ পেয়েছি এত বছর পরে, সেই আশা অপূর্ণ থেকে যাবে?

অনেকের বারণ না শুনেই চলে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে – ২৯ আগস্ট। বহু মানুষের সঙ্গে আড্ডা হয়েছে, একেবারে আপন করে নিয়েছিলেন ও দেশের মানুষ। কিন্তু দেশে ফিরে এসে এইসব কথা কাকে বলবো! এখানকার মানুষকে যদি আমি বলতাম, আমাকে প্রায় মেরেই ফেলছিল – বাংলাদেশ থেকে কোনোমতে বেঁচে ফিরে এসেছি – তাহলে বহু মানুষ আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইতো। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেন বাংলাদেশের এইসব অভিজ্ঞতার কথাই শুনতে চাইছে আজকাল,’ বলছিলেন রাজা গাঙ্গুলি।

তার কথায়, বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার চলছে ভারতে এবং তার আজন্ম পরিচিত বহু মানুষও বিশ্বাস করে ফেলছেন সেসব কথায়।

কলকাতার বাঙালিরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে?

রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী বা সরকারি স্তরে বাংলাদেশের আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাবলি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নানা কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতির পরিসরের বাইরে পশ্চিমবঙ্গের বা বলা ভালো কলকাতার সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালিরা আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে কী ভাবছেন? তারা কি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, না তাদের মধ্যে কোনো অনীহা কাজ করছে, নাকি তারা হতভম্ব বা ‘শকড’?

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ও রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী বলছিলেন, ‘দুই বাংলার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে যে সাংস্কৃতিক-বৌদ্ধিক আদান-প্রদান ছিল, যাতায়াত ছিল, সেটা আবার কবে মসৃণ হবে, স্বাভাবিক হবে, সেটা নিয়ে একটা আক্ষেপ বা উদ্বেগ রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কি না যদি জানতে চান, তাহলে সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নানা অবস্থান, নীতি, তাদের ভূমিকা নিয়ে একটা সংশয় কাজ করছে।’

‘মনে হয়নি অন্য দেশে এসেছি’

কলকাতায় ব্যবসা করেন অভিজিৎ মজুমদার। তার পৈতৃক ভিটে ছিল বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার পাটকেলঘাটার বড় কাশীপুর গ্রামে। পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে চলে আসা অনেক পরিবারের মতোই নিজের পূর্বপুরুষের জন্মভিটে দেখার ইচ্ছা ছিল তার দীর্ঘদিনের। সেই ইচ্ছা পূরণ করতে গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশ গিয়েছিলেন মজুমদার।

‘শুধু সাতক্ষীরা নয়, আমি বরিশাল, যশোর, খুলনা আর ঢাকা – অনেক জায়গাতেই গিয়েছিলাম। ঢাকায় আমি ছিলাম ঈদের সময়ে। বাস, গাড়ি, রিকশায় চেপে ঘুরেছি, মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। একটুও আলাদা কিছু মনে হয়নি যে আমি অন্য কোনো দেশে এসেছি,’ বলছিলেন অভিজিৎ মজুমদার।

তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত আলাপের সময়ে ভেতরে ভেতরে শেখ হাসিনার সরকার নিয়ে বেশ কিছু ক্ষোভের কথা শুনেছি – যেমন ভোট দিতে না পারা বা জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য ইত্যাদি। ভারত সম্পর্কেও বিশেষ কিছু ক্ষোভের কথা কিন্তু বলেননি ও দেশের মানুষ। কিন্তু এক-দেড় মাসের মধ্যেই যে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে, সেটার কোনো আন্দাজ আমি অন্তত পাইনি।’

আগস্টে গিয়ে যা দেখলেন কলকাতার বাসিন্দা

অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী রাজা গাঙ্গুলি আবার ৫ আগস্টের পরের চিত্রটা দেখে এসেছিলেন নিজের চোখে।

‘চেচরি গ্রামের কাছে ভাণ্ডারিয়া স্কুলে আমার বাবা পড়তেন, আবার সেখানেই এক বছর হেডমাস্টার ছিলেন আমার ঠাকুরদা। বরিশাল শহর থেকে একজন আমাকে গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন,’ বলছিলেন গাঙ্গুলি।

তার কথায়, ‘খুঁজে পেতে যখন ওই স্কুলে পৌঁছাই, সেখানে দেখি বোর্ডে আমার ঠাকুরদার নাম এখনও রয়েছে। এখন স্কুলের যিনি হেডমাস্টার, তিনি অনেকক্ষণ গল্প করলেন। আমরা খুব কম সময়ের জন্য গিয়েছিলাম, বারবার বলতে থাকলেন—এভাবে এলে হবে না, আমাদের সঙ্গে খেতে হবে—আবার অবশ্যই আসবেন।’

গ্রামের মানুষের আপন করে নেওয়ার কথা যেমন তিনি বলছিলেন, তেমনই সেখানে এক বৃদ্ধকে খুঁজে পেয়েছিলেন রাজা গাঙ্গুলি। তিনি পদবিটা শুনে মনে করতে পারলেন যে তাদের পরিবার কোন জায়গায় থাকতো।

‘ওই ভদ্রলোক আমাকে বললেন, আমার ঠাকুরদা ১৯৬২ সালে চলে আসার সময়ে কোনো জমিজমা বিক্রি করে আসেননি – এমনিই থাকতে দিয়ে চলে এসেছিলেন,’ জানান রাজা গাঙ্গুলি।

তার মনে হয়েছে, যে বাংলাদেশের মানুষের একাংশের মধ্যে একটা অভিমান আছে যে, কলকাতার বাঙালিরা তাদের কিছুটা ‘হেয়’ চোখে দেখেন। আবার কলকাতার বাঙালিদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গত কয়েক বছর ধরেই।

সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে বাধা তৈরি হয়েছে?

একই ভাষা এবং সংস্কৃতির কারণে দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালিদের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক বিনিময় থেকেছে নানা স্তরে। দুই দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা গেছেন অন্য দেশে, আবার অধ্যাপক-ছাত্রছাত্রীরাও শিক্ষাক্ষেত্রের নানা কর্মসূচিতে পাড়ি দিয়েছেন অপর দেশটিতে। আবার কেউ খুঁজতে গেছেন অন্য দেশে ফেলে আসা পিতৃপুরুষের জন্ম-ভিটে। দুই দেশের সাংবাদিকরাও নিয়মিত যাতায়াত করেছেন।

কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর বলেন, ‘ঢাকা আর কলকাতার মধ্যে একটা নিয়মিত যাতায়াত ছিল নানা স্তরে। যেমন- আমি গত বছর একুশে বইমেলার সময়ে সেখানে ছিলাম। আবার ওদিক থেকেও বেড়াতে এলে বা ভারতের অন্য শহরে আসা-যাওয়ার পথে কলকাতা একবার ছুঁয়ে যেতেন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ। ভিসা দেওয়ার সংখ্যা থেকেই বোঝা যায় কত মানুষ এদিক থেকে যেতেন আর ওদেশ থেকে এখানে কত মানুষ আসতেন।’

‘যদিও ভারত-বিদ্বেষ চিরকালই ছিল বাংলাদেশের একটা অংশের মধ্যে, তবুও হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত ছিল, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক – যেটাকে আমরা পাবলিক স্ফিয়ার বলি, সেটা অক্ষত ছিল। তবে আগস্টের পর থেকে একটা অনিশ্চয়তা এবং অবিশ্বাসের বাতাবরণ নিশ্চিতভাবেই তৈরি হয়েছে,’ বলছিলেন স্নেহাশিস শূর।

চেনা বাংলাদেশ কি হঠাৎই অচেনা?

বাংলাদেশের কথা বললেই পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে পদ্মার ইলিশ, ঢাকাই জামদানি – এই দুটোই সবচেয়ে বেশি পরিচিত শব্দ থেকেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়ম করে বাংলাদেশ থেকে পদ্মার ইলিশ রপ্তানি করা এতা দুর্গাপূজার আগে।

গত বছর পদ্মার ইলিশ আসবে কি না, তা নিয়ে প্রথমে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, যদিও শেষমেশ তা এসেছিল। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিতর্কও হয়েছে বিস্তর। কলকাতার বাঙালিদের কেউ কেউ এমন মন্তব্যও চোখে পড়েছে যে, ‘দরকার নেই আমাদের পদ্মার ইলিশের’। সামাজিক মাধ্যমের বাইরে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মধ্যেও উঠে এসেছে সেসব কথা।

কলকাতার প্রকাশক সংস্থা আখর প্রকাশনীর কর্তা রৌণক মৌলিক সম্প্রতি গিয়েছিলেন বাংলাদেশে।

তিনি বলছিলেন, ‘দুই দেশের মানুষ কি সবাই একে অপরকে এতদিন বুকে জড়িয়ে ধরছিলাম? নাকি আমরা ভাবছিলাম যে, বাংলাদেশ খানিকটা আমার মতো করেই চলবে আর মাঝে মধ্যে ইলিশ পাঠাবে? আমাদের জীবনে তো বাংলাদেশের অবদান এটুকুতেই এসে ঠেকেছিল যে, বইমেলায় সেদেশের কিছু প্রকাশক এসে বই বিক্রি করবেন আর মাঝে মাঝে হুমায়ুন আহমেদ আর সুনীল গাঙ্গুলির ছবি একসঙ্গে দেখা যাবে আর বাংলাদেশ আমাদের ইলিশ পাঠাবে।’

‘কিন্তু বাংলাদেশ যদি তার কথাগুলো তুলতে শুরু করে, যখন প্রশ্ন করে যে কেন ফেলানী খাতুনকে কাঁটাতারে ঝুলতে হবে, তখন এপারের বাঙালিরা সমস্যায় পড়ে যান। এই মুশকিলটাই তাদের এখন হচ্ছে।’

বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, আসলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যে ভারত-বিরোধিতার কারণগুলো থেকে গেছে, সেসব শেখ হাসিনার সময়কালে কলকাতার বাঙালিদের সামনে আসেনি। সে কারণেই কি হঠাৎ করে বাংলাদেশকে অচেনা লাগতে শুরু করেছে কলকাতার মানুষের?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী বলছিলেন, ‘কলকাতার মানুষের কাছে বাংলাদেশের এই ঘটনাপ্রবাহ কিছুটা অপ্রত্যাশিত ছিল। সে কারণে তারা কিছুটা হতভম্ব। আসলে কলকাতার শিক্ষাবিদ বলুন বা শিল্প-সংস্কৃতির জগতের মানুষদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকদের ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল। ফলে তাদের শাসনের বিরুদ্ধে যে জনমত তৈরি হচ্ছিল, তা যত শতাংশ মানুষের মধ্যেই থাকুক না কেন, সেটার সম্পর্কে এদিককার মানুষরা অবহিত ছিলেন না।’

‘যেটা আমরা মাঝে মধ্যে যাতায়াত করে উপলব্ধি করতাম, সেই খবর কিন্তু কলকাতার সাধারণ মানুষের কাছে ছিল না। তারা যে এখন শকড্, সেটার কারণ এটাই এবং সেজন্যই তারা বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহকে মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না,’ বলছিলেন অধ্যাপক সব্যসাচী।

সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/

Read Entire Article