মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩ শতাংশ বাড়িয়েছিল বিএমডিসি

16 hours ago 1
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে টানা চার মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও রয়ে গেছে সেই কোটা। এখন শিক্ষায় কোটা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ফেসবুকে কোটাবিরোধী অবস্থান নিলেও সরকারের অবস্থান অস্পষ্ট। তবে বেকায়দায় আছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। একদিকে ভর্তি পরীক্ষার ফল বাতিল করে পুনরায় ফল প্রকাশে শিক্ষার্থীদের আলটিমেটাম, অন্যদিকে সরকারের প্রজ্ঞাপন দুটোকেই আমলে নিতে হচ্ছে তাদের। সংস্থাটি বলছে, এটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে অজুহাতে কোটা দেওয়া হচ্ছে এটি যৌক্তিক নয়। বলা হচ্ছে, আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে। আসলে আপিল বিভাগ কোনো বাধ্যবাধকতা দেননি। বরং নারী, শিশু ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বাইরে কোনো ধরনের কোটা পদ্ধতি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেটা যেই দিক বা বলুক।

গত বছর মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য দুই শতাংশ কোটা ছিল। এটি বাড়িয়ে এবার পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে। তবে তা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য। কোটা বৃদ্ধির ফলে এবার ৭৩ নম্বর পেয়েও কেউ ভর্তি হতে পারেনি, আবার ৪০-৪১ পেয়েও অনেকে ভর্তি হতে পারছে। এ নিয়েই আপত্তি শিক্ষার্থীদের। তাদের দাবি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পোষ্য কোটাসহ সব ধরনের বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করতে হবে।

২ শতাংশ কোটা যেভাবে ৫ শতাংশ হলো

২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা ছিল। ওই বছর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়। কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিলেন তখনকার আন্দোলনকারীরা।

তবে সেই পথে না হেঁটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা পুরোপুরি তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন। রাগ বা ক্ষোভের বশে তিনি ওই ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে পরে স্বীকারও করেন। ঘোষণা অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

২০১৯ সালের ৩০ জুলাই তৎকালীন সরকার জানায়, সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা আর বহাল নেই। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে (১৪তম থেকে ২০তম পর্যন্ত) কোটা বহাল রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে সাধারণ প্রার্থীর মেধাতালিকা থেকে তা পূরণ করতে হবে।

২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কোটার বিষয়ে আগের (২০১৮ সালের) জারি করা পরিপত্র স্পষ্ট করা হয়। পাশাপাশি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সরকারি চাকরিতে অষ্টম বা তার ওপরের পদেও সরাসরি নিয়োগে কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন হয়।

এদিকে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষে অহিদুল ইসলাম তুষার নামে এক ব্যক্তি ২০২১ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। রিটের শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বছরের ৫ জুন ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন। এতে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা পুনরায় ফিরে আসে।

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। ওইদিন থেকেই ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামেন। তারা ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে দেওয়া পরিপত্র পুনর্বহালেরর দাবি জানান। একই সঙ্গে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবি করেন।

তুমুল আন্দোলনে কার্যত অচল হয়ে পড়ে দেশ। জারি করা হয় কারফিউ। এরপর গত ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় দেন, সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য এক শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ কোটা থাকবে। এর ধারাবাহিকতায় ২৩ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

গত ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশ মেডিকেল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) ২০২৫ সালের মেডিকেল কলেজে ভর্তির নীতিমালা প্রকাশ করে। এর ৯.১.১ ধারায় বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত বছরের ২৩ জুলাইয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষায় ৫ শতাংশ আসন মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২৩ জুলাইয়ের প্রজ্ঞাপনে লেখা ছিল, কোটা শুধু চাকরির জন্য প্রযোজ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য এ প্রজ্ঞাপন প্রযোজ্য, এমন একটি বর্ণও ছিল না।

এ ব্যাপারে বিএমডিসির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য দুই শতাংশ কোটা ছিল। এবার কোর্টের নির্দেশনা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে সেটি বাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে।’

আওয়ামী লীগও এখন কোটাবিরোধী!

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। সেই আওয়ামী লীগ এখন কোটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সমালোচনা করছে কোটার। মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় কোটায় সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে আওয়ামী লীগ তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছে।

পোস্টে আওয়ামী লীগ লিখেছে, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৭০ নম্বর পেয়েও চান্স মেলেনি, কোটায় ৪০-৪১ পেয়ে ভর্তির সুযোগ।’

পোস্টের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ কয়েকজন উপদেষ্টা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের কয়েকজন নেতা এবং ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে যুক্ত করে একটি ফটোপোস্ট দিয়েছে। এতে আরও লিখেছে, ‘অবৈধ সরকার দেশটাকে করেছে ছারখার’।

কোটা নিয়ে আওয়ামী লীগের এই পোস্টের পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য করেন অনেকে। কেউ কেউ এই পোস্টের সমর্থন করলেও বেশিরভাগ মন্তব্যকারী সমালোচনা করেন।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংবিধানে নেই

কোটা রাখার ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের মতামত উদ্বৃত করেন অনেকে। সরকারি চাকরিতে কোটা বিষয়ে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে মতামত দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে মেধাকে পেছনে রেখে কোটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না। আগে মেধা, পরে অন্য কিছু। আমাদের দেশের সংবিধানে নারী, শিশু ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কোটা আছে। এর বাইরে কোনো কোটা নেই। সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো কোটা পদ্ধতি করার অধিকার নেই কারও। সরকার করুক বা আপিল বিভাগ বলুক, সেটা সংবিধানের পরিপন্থি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও কোটার বিধান সংবিধানে নেই, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঁচ শতাংশ কোটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

আহসানুল করিম বলেন, ‘২৩ জুলাইয়ের প্রজ্ঞাপনটি চাকরির জন্য। এটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে করে থাকলে অবৈধভাবে করেছে। এই কোটার জন্য এত বড় অভ্যুত্থান হয়ে গেলো, এটা মনে রাখা উচিত ছিল। এই পলিসি করার আগে সরকারের কাছে জানার দরকার ছিল।’

আপিল বিভাগ বাধ্যবাধকতা দেয়নি

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোটা দরকার আছে কি নাই, এটা রাষ্ট্রের পলিসির বিষয়। তারা চাইলে রাখবে, না চাইলে বাদ দেবে। এ বিষয়টি আপিল বিভাগও আবশ্যক করেনি, বলেছে- চাইলে করতে পারে।’

২৩ জুলাইয়ের প্রজ্ঞাপন আংশিক প্রতিপালনের বিষয়ে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘কোনো প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করলে পুরোটাই করতে হবে। আংশিকভাবে করলে সঠিক হয়নি। এটা আইনের ব্যত্যয়। আওয়ামী লীগ আমলেও আমরা দেখেছি, আদিবাসী কোটায় সব সময় বাঙালিদের নেওয়া হয়েছে। আমার কাছে এরকম তথ্যপ্রমাণই আছে।’

কোন কোটায় কতজন

২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় মোট আবেদন করেন এক লাখ ৩৫ হাজার ৬৬৫ জন। এর মধ্যে এক লাখ ৩১ হাজার ৭২৯ জন পরীক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ৬০ হাজার ৯৫ জন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৬৮৬ জনের মধ্যে পাস করেন ১৯৩ জন। তাদের জন্য বরাদ্দ আসন ৫ শতাংশ বা ২৬৯টি। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ৯৪৬ জনের মধ্যে ২৮২ জন পাস করেছেন। তাদের জন্য ৩১টি আসন বরাদ্দ। সমতলের উপজাতি ২৫৫ জনের মধ্যে ৬৬ জন পাস করেছেন। তাদের জন্য আটটি আসন বরাদ্দ।

এবার ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ৪৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। পাস নম্বর ৪০। সর্বোচ্চ নম্বর ৯০ দশমিক ৭৫ পেয়েছেন একজন শিক্ষার্থী। সরকারি মেডিকেল কলেজের পাঁচ হাজার ৩৮০টি আসনে এবং ৬৭টি অনুমোদিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছয় হাজার ২৯৩টি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল প্রণীত নীতিমালার শর্তানুযায়ী ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বর, এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি/সমমান পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএ থেকে প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে অর্জিত স্কোরের ভিত্তিতে মেধা ও পছন্দক্রম অনুযায়ী পাঁচ হাজার ৩৭২ জন পরীক্ষার্থী ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া দেশের সমতল অঞ্চলের উপজাতীয় কোটার (কোড নম্বর ৭৭) শিক্ষার্থীদের তালিকা কোটার স্বপক্ষে সনদ/প্রমাণকসমূহ স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর যাচাই শেষে পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করা হবে।

সরকারি মেডিকেল কলেজে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের ভর্তির সময়সীমা আগামী ২ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির অনলাইন আবেদন গ্রহণের বিজ্ঞপ্তি ২৩ জানুয়ারি প্রকাশ করা হবে।

কোটা বাতিলের দাবি শিক্ষার্থীদের

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি রাখার প্রতিবাদে গত রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। এসময় তারা কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন। পরদিন সোমবার (২০ জানুয়ারি) সকাল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা এক কঠিন গণআন্দোলনের মধ্যদিয়ে স্বৈরাচার পতনের ইতিহাস লিখেছি। মনে রাখতে হবে, এই কোটা আন্দোলনের মাধ্যমেই সেই গণআন্দোলনের শুরু। কিন্তু বর্তমান সরকারের ছয় মাস হয়ে গেলেও এখনো কোটা প্রথার বিলুপ্তি দেখতে পাইনি। এখনো কেউ কোটার জোরে ৪১ পেয়ে চান্স পায়, আরেকজন ৭৩ পেয়েও চান্স পায় না।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যেই বৈষম্য নিরসন করতে গিয়ে আমাদের রাজপথে নামতে হয়েছিল, সেই বৈষম্য দূর করতে যদি আবারও নামতে হয়, তাহলে এই সরকারেরও পরিণতি হাসিনার মতো হবে।

পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে পুনরায় প্রকাশের দাবি জানিয়েছে। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা বলেছে, ২৪ এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার শুরুই হয়েছিল মূলত বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি থেকে। এই কোটা ব্যবস্থা বহাল থাকা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যা মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মনে করিয়ে দিতে চায়, শহীদ ও আহতদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই সরকার। ফলে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান-উত্তর আওয়ামী ফ্যাসিবাদী আমলের তৈরি বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার অপব্যবহারের দায়ভার কেবল তাদের ওপরই বর্তায়। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেবল অনগ্রসর শ্রেণির ‘উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কোটা রেখে অন্য সব অযৌক্তিক কোটা বিলোপ এবং সদ্য প্রকাশিত এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পুনরায় প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।

সিদ্ধান্তহীনতায় স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর

ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে বেশ বেকায়দায় পড়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। তাদের একদিকে চলমান নীতিমালা মানতে হচ্ছে। আবার বড় অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকেও অবজ্ঞা করতে পারছে না। এ নিয়ে দফায় দফায় শীর্ষ কর্তাদের বৈঠকেও আসছে না সমাধান।

গত সোমবার (২০ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে কথা বলে জানা গেছে, তাদের হাতে হাইকোর্টের রায় ও সরকারের প্রজ্ঞাপন আছে। সে আলোকে তারা কোটা রেখেছে। এর বাইরে তাদের যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়টিও তাদের বেশ ভাবাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় শিক্ষার্থীদেরই সরকার। তারা চাইলে তো কোটা বাতিল করতে পারতো। সেটি তো করেনি। যেহেতু বাতিল করেনি, সেহেতু আমাকে তো বিদ্যমান প্রজ্ঞাপন ও রায়কেই প্রতিপালন করতে হবে।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. রুবীনা ইয়াসমীন জাগো নিউজকে বলেন, “আমরা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ‘মেডিকেল/ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস/বিডিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা-২০২৫’ অনুসরণ করেছি। সেখানে হাইকোর্টের রায় ও সরকারের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনের আলোকেই কোটা রাখা হয়েছে। আমরাও তাই করেছি। সরকার এ বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত দিলে আমরা সেটা প্রতিপালন করবো।”

ডা. রুবীনা ইয়াসমীন বলেন, ‘আমরা কোটায় উত্তীর্ণদের প্রমাণাদি যাচাই করবো। আসলেই তারা সংশ্লিষ্ট কোটার উপযোগী কি না। এজন্য আমরা ২৩ ও ২৬ জানুয়ারি পিছিয়ে পড়া পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর কোটায় নির্বাচিত প্রার্থীদের প্রমাণাদিসহ অধিদপ্তরে ডেকেছি। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত আসনে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের কোটার সপক্ষে সনদ/প্রমাণকসহ ২৭, ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি ডেকেছি। প্রমাণাদি যাচাই করে ঠিক পাওয়া গেলে ভর্তির সুযোগ পাবে, না হলে পাবে না।’

এ প্রমাণাদি যাচাইয়ের বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছে। একই বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মেডিকেল কলেজ ২০২৪-২৫ সালের এমবিবিএস ভর্তি কার্যক্রমে ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিদ্যমান বিধি অনুসারে শুধু মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের জন্য প্রযোজ্য হবে, তাদের নাতি-নাতনি বা অন্য কারও জন্য প্রযোজ্য হবে না। এই কোটার অধীনে সংরক্ষিত ২৬৯টি আসনের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১৯৩ জন প্রার্থী পাওয়া গেছে। অবশিষ্ট ৭৬টি আসন এরইমধ্যে মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হয়েছে। এই কোটায় প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ১৯৩ জনের পিতা/মাতার মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র, নিজের জন্মনিবন্ধন সনদসহ যাবতীয় প্রমাণাদি ও একাডেমিক সার্টিফিকেট নিয়ে আগামী ২৯ জানুয়ারি মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরোনো ভবনের দোতলায় অবস্থিত মেডিকেল এডুকেশন শাখায় উপস্থিত হয়ে যাচাই-বাছাই করাতে হবে। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল বা অসত্য তথ্য পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর ভর্তি বাতিল হবে এবং মেধাতালিকা থেকে সেই শূন্য আসন পূর্ণ করা হবে। এই যাচাই-বাছাই কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ১৯৩ জনের ভর্তি সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। অবশিষ্টদের ভর্তিসহ মেডিকেল কলেজের অন্য কার্যক্রম যথারীতি চালু থাকবে।

নীরব সরকার

এ নিয়ে সরকারের একাধিক উপদেষ্টার বক্তব্য নিতে যোগাযোগ করেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। রাজনৈতিক নেতারাও এ নিয়ে কথা বলতে নারাজ।

তবে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোটা কোনো একটা যৌক্তিক পদ্ধতি নয়। এটা আধুনিক কোনো দেশের প্রত্যাশিত পদ্ধতি হতে পারে না। কেউ প্রিফার করতে পারে না। তবে বাংলাদেশের কিছু বাস্তবতা আছে। এখানে আসলেই কিছু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আছে। এখানে নারীরা যাতে এগিয়ে আসতে না পারে, সে আয়োজন আছে। বিভিন্ন শুমারি ও গবেষণা সামনে রেখে অংশীজনদের সঙ্গে বসে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য কোটার মাত্রা ঠিক করতে হবে।’

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি রিজওয়ান আহমেদ রিফাত জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পোষ্য কোটাসহ বৈষম্যমূলক সব কোটা বাতিল চাই।’

মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপর জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম তার ফেসবুকে লেখেন, ‘ভর্তি পরীক্ষায় এখনো কিসের কোটা? আজ থেকেই এই শোষণের শেষ হতে হবে। ফুলস্টপ।’

এসইউজে/এমএমএআর/এএসএম

Read Entire Article