যেভাবে হজরত ওমরের (রা.) খেলাফতভুক্ত হয়েছিল জেরুজালেম

2 days ago 2
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

১৩ রমজান, ১৫ হিজরি (১৮ অক্টোবর ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দ) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ফিলিস্তিনে পৌঁছেন এবং জেরুজালেম শহরের চাবি গ্রহণ করেন। তিনি খ্রিস্টানদের জান-মালের নিরাপত্তা এবং তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেন।

জেরুজালেম বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। মুসলমানদের বিজয়ের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে সাসানীয়রা বাইজেন্টাইন-পারস্য যুদ্ধের সময় শহরটি দখল করে। পারস্যবাসীরা শহর লুট করে প্রায় ৯০ হাজার খ্রিস্টানকে হত্যা করে এবং শহরের সবাইকে অত্যাচার করে। ইহুদিরাও এতে সহযোগিতা করেছিল।
আল্লাহর রাসুলের (সা.) ইন্তেকালের পর আবু বকর সিদ্দিক (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব নেন। তিনি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং আরব উপদ্বীপে ইসলামের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি পূর্বদিকে ইরাক আক্রমণ করেন, যা ছিল সাসানীয় সাম্রাজ্যের একটি অংশ। পশ্চিম দিকে তার বাহিনী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আক্রমণ করে।

হজরত আবু বকরের (রা.) ইন্তেকালের পর ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার সময় বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বড় অভিযান চালান। কিন্তু তিনি ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ঐতিহাসিক ইয়ারমুক যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজিত হন।

ইয়ারমুক যুদ্ধে বিজয়ের পর, আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ (রা.)-কে রোমানদের পিছু ধাওয়া করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি হিমসে পৌঁছান এবং সেখান থেকে নিজ বাহিনী নিয়ে দামেস্কে অবস্থান করেন। এরপর তিনি সিরিয়া চারটি অঞ্চলে ভাগ করেন; দামেস্ক এবং তার আশপাশের এলাকা ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ানের অধীনে ন্যাস্ত করেন। ফিলিস্তিন আমর ইবনে আস (রা.)-এর অধীনে, জর্ডান শুরাহবিল ইবনে হাসানার (রা.) অধীনে ন্যাস্ত করেন। হিমস এবং আশপাশের এলাকা আবু উবাইদার (রা.) অধীনে থাকে।

দামেস্ক বিজয়ের পর আবু উবাইদা (রা.) জেরুজালেমের অধিবাসীদের ইসলামের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তাদের কাছে চিঠি পাঠান। কিন্তু তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন তিনি নিজের বাহিনী নিয়ে জেরুজালেম শহর অবরোধ করেন। স্থানীয় পাদ্রিরা জানায় এই শহর একমাত্র সেই ব্যক্তি দখল করতে পারবে, যার নাম তিনটি অক্ষরের এবং যার শরীরের গঠন একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বহন করে। মুসলমানরা বুঝতে পারে যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) সঙ্গে মিলে যায়।

হজরত ওমর (রা.) ওসমান ইবনে আফফান (রা.) ও আলী ইবনে আবি তালিবের (রা.) পরামর্শ নেন। ওসমান (রা.) তাকে জেরুজালেমে না যাওয়ার পরামর্শ দেন আর আলী (রা.) যাওয়ার পরামর্শ দেন। ওমর (রা.) আলীর (রা.) মত গ্রহণ করেন। তিনি মদিনা থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং আলীকে (রা.) মদিনার দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।
ওমর (রা.) সরাসরি জেরুজালেমে না গিয়ে জাবিয়ায় যান। সেখানে মুসলিম বাহিনী তাকে স্বাগত জানায়। আবু উবাইদা (রা.) খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) এবং ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) তাকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি সেখানে এক বক্তৃতায় বলেন, লোকসকল! তোমাদের গোপন বিষয়গুলো ঠিক করো, তাহলে তোমাদের প্রকাশ্য বিষয়গুলো ঠিক হবে। আখিরাতের জন্য কাজ করো, তাহলে দুনিয়ার ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে না।

জেরুজালেমবাসীর দাবি অনুযায়ী হজরত ওমর (রা.) পায়ে হেঁটে জেরুজালেম শহরের দরজায় উপস্থিত হন। তাকে দেখে জেরুজালেমের পাদ্রীরা যখন বুঝতে পারে যে ইনিই খলিফা, তারা আনন্দের সাথে শহরের চাবি তাঁর কাছে হস্তাস্তর করে কারণ খলিফার এই বর্ণনাই তারা তাদের কিতাবে পেয়েছিল।

চাবি হাতে পেয়ে ওমর (রা.) আনহু সিজদায় লুটিয়ে পড়ে দীর্ঘসময় কাঁদলেন। তাঁকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি যে আমার ভয়ে হচ্ছে যে পৃথিবী তোমাদের সামনে খুলে দেওয়া হবে। তখন তোমরা একে অপরকে ভুলে যাবে। তোমাদের মাঝে কোনো ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ থাকবে না। তখন আল্লাহ তা‘আলাও তোমাদের দূরে ঠেলে দেবেন।

ওমর (রা.) খ্রিস্টানদের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি করেন, যা ইতিহাসে ‘আল-আহদুল উমরিয়্যাহ’ নামে পরিচিত।

এই চুক্তিনামায় লেখা ছিল,

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

এটি সেই নিরাপত্তার চুক্তি যা আল্লাহর বান্দা ওমর, আমিরুল মুমিনীন, জেরুজালেমের (ইলিয়ায়) অধিবাসীদের জন্য প্রদান করেছেন। তিনি তাদের নিজেদের জীবন, সম্পদ, গির্জা, ক্রুশ, অসুস্থ ও সুস্থ সকল মানুষের জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তাদের গির্জাগুলোতে কেউ বসবাস করবে না, সেগুলো ধ্বংস করা হবে না, সেগুলোর কোনো অংশ বা সীমানা কমানো হবে না, তাদের ক্রুশ ও সম্পদে কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না। তাদের তাদের ধর্ম পালনে বাধ্য করা হবে না, তাদের কারো কোনো ক্ষতি করা হবে না।

তবে জেরুজালেমে তাদের সঙ্গে কোনো ইহুদি বসবাস করবে না। জেরুজালেমের অধিবাসীদের অন্যান্য শহরের বাসিন্দাদের মতো জিজিয়া কর দিতে হবে এবং তাদের শহর থেকে রোমানদের বের করে দিতে হবে। যারা রোমানদের সঙ্গে চলে যেতে চায়, তারা তাদের সম্পদসহ নিরাপদে যেতে পারবে এবং তাদের গির্জা ও ক্রুশ পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে যাবে। তারা তাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত নিরাপত্তা পাবে। যারা জেরুজালেমে থাকতে চায়, তারা এখানেই থাকতে পারবে, তবে তাদের ওপরও জিজিয়া কর পরিশোধের দায়িত্ব থাকবে। যারা রোমানদের সঙ্গে যেতে চায়, তারা যেতে পারবে এবং যারা নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে চায়, তারা ফিরে যেতে পারবে।
এ চুক্তিনামার সব কিছু আল্লাহ, তার রাসুল, খলিফা এবং মুসলমানদের অঙ্গীকার, যদি তারা তাদের ওপর আরোপিত জিজিয়া পরিশোধ করে।

খালিদ ইবনে ওয়ালিদ, আমর ইবনে আস, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, এবং মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান এ চুক্তিনামার সাক্ষী হিসেবে আছেন। চুক্তিনামাটি ১৫ হিজরিতে লেখা ও স্বাক্ষরিত হয়।

চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর পাদ্রি সাফরোনিয়াস ওমরকে (রা.) চার্চ অব দ্য হলি সেপালচার দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেখানে নামাজের সময় হলে তিনি চার্চের ভেতরে নামাজ পড়তে অস্বীকৃতি জানান, কারণ এতে মুসলিমরা ভবিষ্যতে এটি দখল করার চেষ্টা করতে পারে। তিনি চার্চের বাইরে একটি স্থানে নামাজ আদায় করেন, যেখানে পরবর্তীতে মসজিদে ওমর নির্মিত হয়।

এভাবে মুসলমানদের শাসনাধীনে আসার পর ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ বছর জেরুজালেম নিরবচ্ছিন্নভাবে মুসলমানদের শাসনাধীন থাকে।

ওএফএফ/এএসএম

Read Entire Article