ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS
বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় ১৬ বছরের কারাবাস শেষে অবশেষে নিজ বাড়ি ফিরলেন ল্যান্স নায়েক আলতাফ হোসেন। বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে আসেন তিনি। এসময় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যায়।
বরগুনা সদর উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা আলতাফ হোসেন। ১৯৯২ সালে তিনি বিডিআরে যোগ দেন। ২০০৯ সালে পিলখানার ঘটনায় গ্রেফতার হন।
দীর্ঘ এ সময়ে মা-সহ পরিবারের ২৬ স্বজনকে হারিয়েছেন আলতাফ হোসেন। স্বজনদের শেষ বিদায় জানাতে একবারের জন্যও পাননি প্যারোলে মুক্তি। একমাত্র মেয়েকে চিকিৎসক বানানোর স্বপ্নও আর পূরণ হয়নি। মুক্তির পর চাকরি পুনর্বহাল এবং ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন আলতাফ হোসেন। এর আগে দুই বছর বয়সী এক ছেলে এবং চার বছর বয়সী এক মেয়েকে রেখে কারাবন্দি হতে হয় তাকে।
মুক্তি পেয়ে আলতাফ হোসেন বলেন, ‘সবচেয়ে কষ্টের ছিল যখন সন্তানরা আমাকে চিনতে পারতো না। বাবাকে সন্তানরা চেনে না, এটা যে কত কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তা অপূরণীয়।’
আলতাফ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ১৬ বছর পর তার মুক্তিতে বাড়িতে আনন্দের ঢল নেমেছে। জামিনে বাড়ি ফিরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন আলতাফ। তাকে ঘিরে স্বজনদের উচ্ছ্বাস।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাবাকে কাছে পেয়ে ছেলে আকিব হোসেন রাফি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাবা হলো একটি পরিবারের বটগাছের মতো। সেই বাবাই ছোটবেলা থেকে আমাদের কাছে ছিল না। ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি বাবা দূরে কোথাও আছেন। বুঝতে শেখার পরে জেনেছি বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় বাবা কারাগারে আছেন। বিষয়টির নেগেটিভ প্রভাব আমাদের মাথায় ছোটবেলা থেকেই পড়েছে। ছোটবেলায় যখন দেখতাম স্কুলের বাচ্চাদের তাদের বাবা এসে নিয়ে যায়। আমি বাবার সেই আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি।’
বর্তমানে বরগুনা সরকারি কলেজে লেখাপড়া করছেন আকিব হোসেন। বাবা ছাড়া শৈশবের কষ্টের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, ‘দীর্ঘবছর বাবাকে ছাড়া আমাদের পথ চলাটা খুবই কষ্টের ছিল। মা একা আমাদের মানুষ করেছেন। এমন সময়ও গেছে মা আমাদের ঠিকমতো খাবার দিতে পারেননি। আমাদের বলতেন, ক্ষুধা লাগলে আমাকে চুমা দাও, দেখবা ক্ষুধা শেষ হয়ে গেছে।’
স্বামীকে ফিরে পেয়ে স্ত্রী শিরীন সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছর একা হাতে পরিবার চালিয়েছি। সন্তানের লেখাপড়া, খাবার, মামলা চালানোর খরচ সবকিছু সামলাতে আমাকে সীমাহীন কষ্ট করতে হয়েছে। দীর্ঘ ১৬ বছর স্বামী থাকতেও একা থাকতে হয়েছে। এ কষ্ট শুধু একজন ভুক্তভোগী নারীই বুঝতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মেয়েটাকে ডাক্তারি পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জেলে থাকায় তা আর সম্ভব হয়নি। আল্লাহর হুকুম এবং আমার বাবা, মা, ভাই ও দেবরের সহযোগিতায় যতটুকু সম্ভব হয়েছে ছেলেমেয়েদের জন্য চেষ্টা করেছি। এমনও অনেক দিন গেছে টাকা নেই, ঘরে খাবার নেই। এটি একজন নারীর জীবনে কতটা কষ্টের, তা বলার ভাষা নেই।’
বন্দি থাকা অবস্থায় স্বজনরা মারা গেলেও আলতাফ হোসেনকে শেষ দেখার সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে জানান শিরীন সুলতানা।
তিনি বলেন, যখন আমার শাশুড়ি মারা যায়, তখন সরাসরি আমি জেলারের কাছে ফোন করেছিলাম। জানাজায় উপস্থিত থাকতে এবং মৃত মাকে দেখার জন্য অনুমতি চাইলেও তিনি তখন বলেন, সম্ভব না।
শিরীন সুলতানা বলেন, ‘আমাদের একটাই দাবি বিনাদোষে কেন আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে? কেন আমাদের জীবন ধ্বংস করা হয়েছে? আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচার চাই। পুনরায় চাকরি ফেরত এবং ক্ষতিপূরণসহ বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবি জানাই।’
দীর্ঘ কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে ল্যান্স নায়েক আলতাফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কারাবাস জীবনে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে কষ্টের ছিল যখন সন্তানরা আমাকে চিনতে পারতো না। বাবাকে সন্তানরা চেনে না, এটা যে কত কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তা অপূরণীয়।’
তিনি বলেন, “৫ আগস্টের আগে ধরেই নিয়েছিলাম আর কখনো হয়তো কারাগার থেকে বের হতে পারবো না। জেলখানায় একটি কথা প্রচলন আছে-‘হয়তো হাঁটিয়া নয়তো খাটিয়া’। আমাদের ধারণা ছিল, আমাদের খাটিয়াই বের হবে। ৫ আগস্টের পর আমাদের ধারণা পাল্টাতে শুরু হয়।”
পিলখানার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে আলতাফ হোসেন বলেন, ‘পিলখানা একটি বড় এলাকা, সবকিছু আমরা জানি না। কী ঘটেছিল তা বলতে পারবো না। নতুন করে তদন্ত করা হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস, এখন সবকিছুরই সঠিক তথ্য বের হয়ে আসবে।’
ভবিষ্যতের ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের বিডিআর সদস্যদের জন্য ‘বিডিআর কল্যাণ পরিষদ’ নামে একটি গ্রুপ আছে। ওই পরিষদের মাধ্যমে আমাদের চাকরির পুনর্বহাল, আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়াসহ যে সিদ্ধান্ত আসবে আমি সেই সিদ্ধান্তে একমত।
আলতাফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেহেতু আমি হত্যা মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি, তাই চাকরি পুনর্বহাল এবং ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়।’
নুরুল আহাদ অনিক/এসআর/এমএস