উত্তর সীমান্তে যে উপায়ে চলছে মাদক চোরাচালান

3 hours ago 1
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

# জয়পুরহাটে মাদক সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ দুই বিএনপি নেতার হাতে
# বিজিবি-বিএসএফ এর সঙ্গে বিশেষ সখ্যতার অভিযোগ
# ঈদের স্পেশাল মিশন, ২০০ চোরাচালানি মাঠে

ঈদকে কেন্দ্র করে জয়পুরহাট সীমান্তে মাদক চোরাচালান নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিশেষ করে ফেনসিডিল, গাঁজা ও নেশাজাতীয় অ্যম্পুলের সহজলভ্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এসব চোরাচালানে শতাধিক ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে জড়িত। বিজিবি-বিএসএফের সঙ্গে আঁতাত করেই চোরাচালান চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ চোরাচালান নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছে স্থানীয় বিএনপি নেতা মিঠু-শাহীন সিন্ডিকেট। এদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তপথে অবৈধ কার্যক্রম চালানোর অভিযোগও রয়েছে। তবে তারা প্রভাবশালী হওয়ায় সংগঠন থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এই দুই গডফাদারের হয়ে বর্তমানে সীমান্তের একাধিক পয়েন্টে সক্রিয় রয়েছে ২ শতাধিক চোরাচালানি। প্রতিরাতে এদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মাদক দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে।

রাতের আঁধারে মাদকের রাজত্ব

সন্ধ্যার পর ভারত সীমান্ত ঘেঁষা জয়পুরহাটের আইমা ইউনিয়নের লকমা ও ধলাহার ইউনিয়নের কল্যাণপুর গ্রামের চিত্র বদলে যেতে শুরু করে। স্থানীয়দের মুখে ফিসফিসানি। তারাও বুঝতে পারে আজ রাতে মাল ঢুকবে।

আরও পড়ুন-

শনিবার (১৫ মার্চ) সরেজমিনে দেখা গেলো সীমান্ত ঘেঁষা নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় সন্ধ্যার পরপরই অচেনা মানুষের আনাগোনা। এদের অনেকে কৃষক বা দিনমজুরের ছদ্মবেশে আসছে। কেউ কেউ সাধারণ পথচারীর মতো চলাফেরা করছে।
স্থানীয় এক তরুণ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এরাই ভারী (মাদক বহনকারী)। রাতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এরা সীমান্তে ছড়িয়ে পড়ে। সিগন্যাল মিললে মাদকের বস্তা ঘাড়ে নিয়ে আশপাশের গ্রামে রাখে। প্রতিটি বস্তায় ৫০ থেকে ১০০ বোতল পর্যন্ত ফেনসিডিল থাকে। এজন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন পায় তারা। বোতলগুলো প্লাস্টিকের হওয়ায় বহনে সুবিধা হয়। সঙ্গে অস্ত্র রাখার উদ্দেশ্য হলো ছোট খাট যে কোনো বাধা তারা নিজেরাই মোকাবিলা করবে।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সদর থানার শেষ সীমানা ধলাহারের কল্যাণপুর এবং পাঁচবিবি থানার লকমা গ্রামের নির্দিষ্ট রুটে কিছু মোটরসাইকেল এবং পায়ে চলা দল সক্রিয় হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই মোটরসাইকেল আরোহীদের কাজ মূলত পণ্য (মাদক) বহন করা, যা ভারতীয় অংশ থেকে চোরাচালান হয়ে আসে।

একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আমরা জানি কখন কী হচ্ছে। কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই। এখানে যারা কাজ করে, তারা সবাই প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে জড়িত।

সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনের সময় দেখা গেলো লকমার শেষ প্রান্ত থেকে সীমান্তের বেড়া মাত্র ১ মিনিটের হাঁটাপথ। মাঝে ছোট একটি খাল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। রাতের অন্ধকারে এই খালপথে কিছু ব্যক্তিকে গোপনে কিছু একটা আনতে দেখা যায়। তারা বাঁশের ভেলা ব্যবহার করছিল। রাত পৌনে ৩টার সময় বিজিবির টহল কিছু কিছু জায়গায় থাকলেও, তারা চোরাকারবারিদের খোঁজার চেষ্টা করছে বলে মনে হলো না। জঙ্গলে ঘেরা বিকল্প রুট ব্যবহার করে সেই ভারি বাহিনীর কাঁধে চেপে পার হয়ে গেলো শত শত বস্তা মাদক।

স্থানীয় এক দোকানি পরদিন রোববার সকালে বলেন, বিজিবি টহল দিলেও সেই জায়গার তথ্য চোরাকারবারিরা আগেভাগেই পেয়ে যায়। তাই কিছুই ধরা পড়ে না।

সিন্ডিকেট যাদের নিয়ন্ত্রণে

মাদকের সবচেয়ে বড় রুট লকমা গ্রামের দুই প্রান্তে দুই গডফাদারের বাড়ি। সীমান্ত ঘেঁষা বাড়িতে থাকেন মিঠু চৌধুরী। তিনি আইমা ইউনিয়ন বিএনপির ১নং ওয়ার্ড কমিটির সদস্য। তার সহকারী হিসেবে রয়েছেন একই ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি গোলজার হোসেন। এই দুইজনের সিন্ডিকেটে একশোর বেশি চোরাকারবারি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

এই এলাকার আরও একজন বড় গডফাদার হলেন বিএনপি নেতা শাহীন চৌধুরী। তার সঙ্গে প্রধান সহযোগী হিসেবে রয়েছেন একই এলাকার ইজতামুল হোসেন। এই গ্রুপটিও শতাধিক চোরাকারবারির দল নিয়ন্ত্রণ করে।

এদের সঙ্গে এপারের বিজিবি ও ওপারের বিএসএফএর রয়েছে বিশেষ সখ্যতা। তারা আগেভাগেই কোন এলাকায় অভিযান চলবে, কোন রুট নিরাপদ তা জেনে যায়। দেশের ইলিশ মাছ, মিষ্টি মিঠাই খাওয়ানো থেকে শুরু করে তারা পাচার করা মাদকের নির্দিষ্ট একটি অংশের টাকাও সীমান্ত রক্ষীদের দিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বিপরীতে প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে ৯টা এবং ভোর ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত তারা মাদক পাচারের সুযোগ পায়। এছাড়া প্রতিদিন রাত ১২টায় সীমান্তে রক্ষী সেন্ট্রিদের ডিউটি পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের সময়টাতে তারকাঁটার ওপর দিয়ে ছুড়ে তারা দেদারসে মাদকের বস্তা পারাপার করে।

অভিযুক্তদের বক্তব্য জানতে তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। কারণ বেশিরভাগ সময়ই এরা ভারতীয় সিমকার্ডে হোয়াটসআপ কিংবা ইমোতে কথাবার্তা বলে। যার জন্য বাংলাদেশের কোনো ফোন নেটওয়ার্কে তাদের পাওয়া যায়নি।

তবে আইমা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইউপি সদস্য সামসুল হুদা বলেন, এরা চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে এরা তার লোক বনে যায়। মিঠু আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার বাবা মোখলেছুর রহমান এখনো আওয়ামী লীগ করেন। শাহীনও আগে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দেশের পটপরিবর্তনের পর এরা এখন বিএনপি বনে গেছেন। তবে দুজনই প্রভাবশালী হওয়ায় হাতেনাতে ধরা না পড়লে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া কিছুটা জটিল। আমরা অপেক্ষায় আছি কখনো পুলিশের হাতে ধরা পড়লেই দল থেকে বহিষ্কার করার।

প্রতিরাতে ঢুকছে ফেনসিডিল ও নেশাদ্রব্য

স্থানীয় সূত্র ও এই কাজে সম্পৃক্ত একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমানে জয়পুরহাটের উচনা সীমান্তের সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকা খোলা রয়েছে। এখানে কোনো তারকাটা নেই। বিজিবির পোস্টে পালা করে প্রহরীরা পাহারা দেন। একইভাবে ভারতীয় অংশের বিএসএফ পাহারা দেয়। কিন্তু এই এলাকাটি মাদক কারবারিদের জন্য হটস্পট। প্রতিরাতে এই সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল, প্যান্টাডিল, গাঁজা ও নেশাজাতীয় ইনজেকশন বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এসব মাদক বাংলাদেশে ঢুকেই ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে তিন ধাপে বিভক্ত হয়ে দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ছে।

এছাড়া তারঘেরা কল্যাণপুর, লকমা, গলাকাটা ব্রীগ, হাটখোলা, শালুয়া, চকবরকত এলাকায় ভিন্ন উপায়ে চলছে চোরাচালান। বস্তায় ভরে মাদক রেডি করে ভারতীয় ডিলাররা বাংলাদেশের ডিলারদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে। তারা কোন পয়েন্ট থেকে মাল ঢুকবে সেটি জানানোর পর নির্দিষ্ট সময়ে বস্তাগুলো তারকাঁটার ওপর দিয়ে ছুড়ে ফেলে বাংলাদেশের জঙ্গলের মধ্যে দেওয়া হয়। এরপর বাংলাদেশি ডিলার ক্যারিম্যান বা বাহকের মাধ্যমে (ভারি সদস্য) সেগুলো কাঁধে করে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে গ্রামের একাধিক বাড়িতে রেখে দেয়। প্রতিটি দলে একজন করে পাইলট থাকেন যিনি টর্চলাইট ও বাটন মোবাইল ফোন নিয়ে তাদেরকে পথ দেখান। তারপরও নিরাপত্তার স্বার্থে এই মালগুলো মূল ডিলারের আরও একটি দল (সাংকেতিক নাম হ্যান্ডলার) ভিন্ন লোকেশনে রাতেই স্থানান্তর করে ফেলে। পরে সর্বশেষ টিম এসে মালগুলো চাহিদামতো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেয়।

এখানে একাধিক টিম কাজ করলেও কেউ কাউকে চেনে না। নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে তারা এই কাজটি করে থাকে।

এছাড়া ভিন্ন আরও একটি কৌশল রয়েছে তাদের। মাঝরাতে বহনের গ্রিন সিগন্যাল না মিললে সীমান্তের ধানক্ষেত বা অন্যান্য কৃষিজমির মাঝে গর্ত করে মাদক লুকিয়ে রাখা হয়। পরে সুবিধাজনক সময়ে বাহকরা এসে তা সংগ্রহ করে।

এছাড়া চোরাকারবারিরা খালে বাঁশের ভেলা তৈরি করে তার নিচে ফেনসিডিলের বোতল বেঁধে ভাসিয়ে দেয়, যা পরে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে তুলে নেওয়া হয়। গৃহবধূ ও কিশোরীদেরও এই কাজে ব্যবহার করা হয়। এরা বিশেষ পোশাকের ভেতরে ছোট ছোট প্যাকেট লুকিয়ে সীমান্ত থেকে মাদক আনে। তবে কাজগুলো দিনের বেলা সুবিধা বুঝে করা হয়।

ঈদের বিশেষ মিশনে ২০০ চোরাচালানি মাঠে

সিন্ডিকেটের পরিকল্পনায় রয়েছে ঈদের আগে মাদকের বিশাল চালান দেশে প্রবেশ করানোর। এজন্য তারা বিশেষ ‘মিশন’ পরিচালনা করছে, যেখানে ২০০’র বেশি দক্ষ চোরাচালানি নিযুক্ত করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানান, ঈদের সময়টা আমাদের জন্য বড় ব্যবসার সুযোগ। এবার অন্তত ২০০ জন নিযুক্ত হয়েছে। সীমান্তের বেশ কিছু জায়গায় নতুন রুট তৈরি করা হয়েছে যাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি কম থাকে।

এ ব্যাপারে জয়পুরহাট ২০ বিজিবি কমান্ডার লে. কর্নেল নাহিদ নেওয়াজ বলেন, আমরা সবসময়ই মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে আছি। নিয়মিত অভিযান হচ্ছে। সীমান্তে কড়া পাহারা চলছে। এরমধ্যেই চুরি করে কেউ এই কাজ করে থাকলে তাদের শনাক্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় বিজিবি বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। তারা এই অভিযান ঈদের আগে আরও জোরদার করবে।

জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইনুল হাসান বলেন, তিনি চিহ্নিত মাদক কারবারিসহ তাদের সহযোগীদের তালিকা তৈরি করছেন। শিগগিরই তাদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করবেন। তবে অভিযানের আগেই তারা সতর্ক রয়েছেন যাতে কোনো মাদক পাচার না হয়।

এফএ/জেআইএম

Read Entire Article