এখনও সংস্কার শুরুই হয়নি?

8 hours ago 4
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

অন্তর্বর্তী সরকারের গত সাত মাসে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ ‘সংস্কার’। অথচ এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারা এখনও সংস্কার শুরুই করেননি। (বিবিসি বাংলা, ০৩ মার্চ ২০২৫)।

প্রশ্ন হলো, সাত মাসে যদি সংস্কার শুরুই না হয়ে থাকে, তাহলে কবে শুরু হবে এবং সেই সংস্কার কবে শেষ হবে? সরকার প্রধান এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বলেছেন যে, রাজনৈতিক দলগুলো কম সংস্কার চাইলে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হবে। আর যদি তারা বেশি সংস্কার চায় তাহলে নির্বাচন হবে আগামী বছরের জুনে। কম সংস্কার ও বেশি সংস্কার বলতে কী বুঝায়—তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল আছে। কেননা সরকারের তরফে এখনও বিষয়টা পরিষ্কার করা হয়নি যে তারা কম ও বেশি সংস্কার বলতে কী বুঝায়?

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য সরকার যে ১১টি কমিশন করেছে, তার মধ্যে ছয়টি কমিশন (সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, দুদক, জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ) এরইমধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে—যেখানে কয়েকশো সুপারিশ রয়েছে। আরও পাঁচটি কমিশন তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেবে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নকে যদি বৃহত্তর আকারের সংস্কার বলে বিবেচনা করা হয়, তাহলে তার সকল সুপারিশ বাস্তবায়ন আগামী বছরের জুনের মধ্যেও সম্ভব হবে না। তাছাড়া কিছু সংস্কার করতে হবে সংসদে। অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে সব সংস্কার করা সম্ভব নয়। কেননা এই সরকার যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, ফলে জনগণ তাদেরকে কোন কোন সংস্কারে ম্যান্ডেট দিয়েছে—সেটি বিরাট প্রশ্ন। তার চেয়ে বড় কথা, সংস্কারের বিষয়ে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য।

সংস্কার কমিশনগুলো যেসব সুপারিশ করেছে, তারওপর এরই মধ্যে মতামত দিতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। পাঁচটি সংস্কার কমিশন বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে ১৬৬টি সুপারিশ করেছে সে বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতসহ মোট ৩৭টি রাজনৈতিক দলের কাছে মতামত জানতে চেয়ে ৬ মার্চ চিঠি দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মতামত জানানোর শেষ দিন ১৩ মার্চ পর্যন্ত সাতটি দল তাদের মতামত জমা দিয়েছে। বিএনপিসহ ১৬টি রাজনৈতিক দল পূর্ণাঙ্গ মতামত দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত কয়েক দিন সময় চেয়েছে। অন্য দলগুলোর সঙ্গে কমিশন আবার যোগাযোগ করছে। (ইত্তেফাক, ১৪ মার্চ ২০২৫)।

কমিশনের সুপারিশের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের ধারাবাহিক আলোচনার কথা শোনা গিয়েছিল এবং সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সবার মতামতের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুতের কথাও শোনা গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, ওই সনদে কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রতিবদ্ধ হবে, যেগুলো নির্বাচনের পরে তারা বাস্তবায়ন করবে। যদিও জুলাই সনদ তৈরির বিষয়ে অগ্রগতি কতটুকু—তা এখনও পরিষ্কার নয়।

সংস্কার ইস্যুতে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের ধারণায় কিছু সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যেমন, সংস্কার বলতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোয় আমূল পরিবর্তন—যেমন প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, জবাবদিহি নিশ্চিত করার মতো বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছে। একইভাবে বিচার বিভাগের সংস্কারেও তাদের সুনির্দিষ্ট কিছু চিন্তা ও পরিকল্পনা রয়েছে।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ও সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনসহ আরও অনেক সুপারিশ করেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেসব নিয়েও সরকার ইতিবাচক বলে মনে হয়। সেইসাথে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা; সংসদে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোসহ আরও কিছু বিষয়ে সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত বলে জানা গেছে। অবশ্য সংস্কার কমিশনও সরকারের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। তারাও সরকারের অংশ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে এ মুহূর্তে ভোটের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর যেসব দল যেমন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলনসহ অন্যান্য দল ঐকমত্যে না পৌঁছালে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।

জামায়াতে ইসলামী এবং সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির অবস্থান আর সরকারের অবস্থানে খুব বেশি পার্থক্য নেই বলে মনে হয়। কিন্তু নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান এই দলগুলোর চেয়ে আলাদা। বিএনপি চায় শুধু একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম যে-সব সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো সম্পন্ন করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা। কিন্তু জামায়াত ও নাগরিক পার্টি মনে করে, বড় আকারে সংস্কার না করে নির্বাচন অর্থহীন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান যদিও বলছেন যে, এখনও শুরুই হয়নি— কিন্তু তারপরও একটি জায়গায় সংস্কার খুব দৃশ্যমান। সেটি হলো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম পরিবর্তন। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও শেখ পরিবারের নাম যুক্ত ছিল, ধারাবাহিকভাবে সেসব প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে দেয়া হয়েছে। এটিকে অবশ্য সংস্কার না বলে বলতে হবে পরিবর্তন। এমনকি টাকায় বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে বলে এ বছর ঈদে ব্যাংকগুলোকে নতুন টাকা দেয়া হবে না বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটিও কি সংস্কারের অংশ?

বিএনপি এবং আরও দুয়েকটি দল মনে করে, যেহেতু এ মুহূর্তে জামায়াত ও নাগরিক পার্টি ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে আসা কঠিন বা এ মুহূর্তে ভোট হলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি, সে কারণে দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি যতটা সিরিয়াস, অন্য দলগুলো ততটা সিরিয়াস নয়। বরং নির্বাচন বিলম্বিত হলে সেইসব দলের সুবিধা। কারণ যত দেরি হবে তারা তত বেশি সময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার সুযোগ পাবে এবং দল গোছানোর সুযোগ পাবে। যে কারণে সংস্কার ইস্যুতে সরকার ও বিএনপির অবস্থান ভিন্ন।

সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ‘সংস্কার’ অর্থ ভিন্ন। যেমন, রাষ্ট্রক্ষমতায় কোন দল বা নির্দলীয় সরকার আছে নাকি সামরিক অথবা সুশীল সরকার আছে, একজন সাধারণ মানুষের কাছে তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, তার জীবনমান কেমন। সে চাকরি বা ব্যবসা করে সংসার চালাতে পারছে কি না। তার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রয়েছে কি না। আগের সরকারের আমলে সে যেমন ছিল, এখন সে তার চেয়ে যদি খারাপ থাকে, তাহলে তার কাছে ‘সংস্কার’ শব্দটি পরিহাস মনে হবে।

সাধারণ মানুষের কাছে সংস্কার কাছে বিনা হয়রানি, বিনা তদবির, বিনা ঘুষ ও সময়ক্ষেপণ ছাড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সেবাসমূহ পাওয়ার নিশ্চয়তা। জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট করতে গিয়ে যদি তাকে আগের মতোই ঘুষ দিতে হয়; তদবির করতে হয়; দিনের পর দিন ঘুরতে হয়—তাহলে সে প্রশ্ন তুলবে, গত সাত মাসে কী পরিবর্তন হলো?

থানা, আদালতসহ সরকারের অন্যান্য যেসব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষকে নানা কাজে যেতে হয়, সেসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে যদি একজন সাধারণ মানুষকে আগের মতোই হয়রানির শিকার হতে হয়; যদি একটি ছোট কাজের জন্যও তাকে এ টেবিল সে টেবিল দৌড়াতে হয়; একদিনে যে সেবাটি পাওয়ার কথা সেটি পাওয়ার জন্য যদি তাকে এক মাস অপেক্ষা করতে হয়; যদি সরকারি অফিসের লোকজন তার সঙ্গে আগের মতোই অসম্মানজনক আচরণ করেন; যদি সরকারি কর্মচারীরা আগের মতোই নিজেদেরকে সুপিরিয়র ভাবতে থাকেন—তাহলে সাধারণ মানুষের মনে এই প্রশ্ন উঠবে যে, গত সাত মাসে কোথায় কী পরিবর্তন হলো? আর যদি এসব সেবা পেতে গিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা আগের চেয়ে ভালো হয়, যদি সত্যিই পরিবর্তনের সূচনা হয়; যদি সরকারি কর্মচারী এবং সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের আচরণ মানবিক হওয়া শুরু করে—তাহলে সেটিকেই সাধারণ মানুষ সংস্কার বলে মনে করবে।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম ও সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন, বিচার বিভাগের নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সরাসরি একজন সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে না। বরং যদি তার কাজের সুযোগ আগের চেয়ে কমে যায়; যদি তার উপার্জন কমে যায় এবং তার জীবনে যদি অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার বোধ আগের চেয়ে বাড়ে, তাহলে তার কাছে গিয়ে সংস্কারের গল্প বলার কোনো মানে হয় না।

সুতরাং, সংস্কার মানে যদি হয় সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন; তার জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা কমানো; তার মধ্যে নিরাপত্তার বোধ সৃষ্টি; তার সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তা বিধান—তাহলে সেই সংস্কারের পক্ষে দলমত নির্বিশেষে সবারই সমর্থন থাকবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান যদিও বলছেন যে, এখনও শুরুই হয়নি— কিন্তু তারপরও একটি জায়গায় সংস্কার খুব দৃশ্যমান। সেটি হলো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম পরিবর্তন। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও শেখ পরিবারের নাম যুক্ত ছিল, ধারাবাহিকভাবে সেসব প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে দেয়া হয়েছে। এটিকে অবশ্য সংস্কার না বলে বলতে হবে পরিবর্তন। এমনকি টাকায় বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে বলে এ বছর ঈদে ব্যাংকগুলোকে নতুন টাকা দেয়া হবে না বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটিও কি সংস্কারের অংশ? তার মানে সংস্কার বলতে সরকার যা বোঝে বা সংস্কার নিয়ে তার যে ধারণা, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তার সব ইস্যুতে ঐকমত্য হওয়ার সম্ভাবনা কম। সাধারণ মানুষের তো বটেই।

সম্প্রতি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কারের দৃশ্যমান অগ্রগতি হবে এবং খুনি, ধর্ষক ও লুটেরাদের বিচার হবে। (সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৩ মার্চ ২০২৫)।

প্রশ্ন হলো, জুলাই সনদ কবে প্রণীত হবে আর কবে নির্বাচন হবে? সেই সনদে কী থাকবে? আর সংস্কার মানে কি শুধু বিচার?

মনে রাখতে হবে, যেসব পদক্ষেপ ও কর্মসূচি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখবে না; যেসব উদ্যোগ সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও বিভাজের রেখা দীর্ঘায়িত করবে—সেগুলোকে সংস্কার বলার সুযোগ নেই। সংস্কার হতে হবে দেশ ও মানুষের স্বার্থে। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এমন একটি দেশের দিকে যাত্রার সূচনা—যে দেশটি হবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগের চেয়ে উন্নত-সমৃদ্ধশালী-মানবিক-সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু। যেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও মৌলবাদের কোনো জায়গা থাকবে না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি থাকবে না। উগ্রপন্থি দলগুলো যেখানে সোচ্চার হওয়ার সাহস পাবে না। এমন একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সেখানে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকবে। এর অন্যথা হলে ‘সংস্কার’ শব্দটি কাজীর গরুর মতো কেতাবেই থাকবে; কখনো আলোর মুখ দেখবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/জেআইএম

Read Entire Article