ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS
নিত্যপণ্যের দামে আরেকটা টোকায় বাজার যথারীতি গরম। কথায় হাতি ঘোড়া মেরে প্রকারান্তরে মানুষকেই মারার আয়োজন। যে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে এর পয়লা ধাক্কাটা পড়ে ভোক্তা পর্যায়ে। ভ্যাট-শুল্ক বাড়লে প্রথমেই আক্রান্ত বিজনেস কমিউনিটি। এরপর শিকার হন ভোক্তারা। সাধারণ এই নিয়মটা বুঝতে অসাধারণ জ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদের কাছে যাওয়া লাগে না। ক্রেতা মাত্রই তা জানে, বোঝে। কিন্তু, সরকারের শীর্ষ জায়গা থেকে শোনানো হলো নতুন থিওরি। পণ্যে শুল্ক-ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ হলে মানুষের ওপর চাপ পড়বে না। এ নিয়ে ক’দিন ট্রল চললো। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে চললো। সরকারের ৪৩টি পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর বা মূসক বা ভ্যাট বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রশ্নেই এসেছিল কথাটা।
কর, শুল্ক, ট্যাক্স বাড়ালে যদি দ্রব্যমূল্যের দাম না বাড়ে, মানুষকে অতিরিক্ত খরচ না করতে হয় তবে তো যতখুশি কর বাড়ানো যেতেই পারে। লাগলে শতগুণ হাজারগুণ কর বাড়ান পণ্যের দাম না বাড়লেই হলো। কর বাড়লেও জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়বে না মনে করে জনগণের সাথে কৌতুকটা না করলে কি হতো না? বাস্তবে কী যাতনাটা যে যাচ্ছে, তার ঠেলা কেবল ক্রেতা নয়, ব্যবসায়ীদেরও সইতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের চাপে ইন্টারনেটসহ ৬৭ পণ্য ও সেবার ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে এনবিআরের জারি করা অধ্যাদেশে টার্নওভারের তালিকাভুক্তি এবং ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা কমানো হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেও ভ্যাটের বিধি-বিধান পরিপালন করতে হবে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বছরে ৩০ লাখ টাকার বেশি টার্নওভার থাকলে ভ্যাটের খাতায় (টার্নওভার করের তালিকাভুক্তি) নাম লেখাতে হবে, যা আগে ছিল ৫০ লাখ টাকা। একই সঙ্গে ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা তিন কোটি থেকে কমিয়ে ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে। ভ্যাট আদায় বাড়াতে জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে এনবিআর।
সরবরাহ পর্যায়ে ওষুধের ভ্যাট ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। ওষুধের দাম এর আগ থেকেই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে গেছে। ওষুধ ছাড়াও এ তালিকায় রয়েছে এলপি গ্যাস, মিষ্টি, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, ফলের রস, সিগারেট, সাবান ও ডিটারজেন্ট, মোবাইল সেবা ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। তরুণদের কাছে জনপ্রিয় ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকসের ওপর সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। এখন কেঁদেও নিস্তার মিলছে না। কর ও ভ্যাটের জটিলতায় দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি এখন আরও অবনতির দিকে। এর মাঝে এলসি সমন্বয়ের দীর্ঘসূত্রতা, ডলার মূল্যের অস্থিরতা, ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চ হার, ভ্যাট দিতে হয়রানি, ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়ার জটিলতা ও উচ্চ ফি অবস্থা আরও বেগতিক করে দিয়েছে।
বৈশ্বিক বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা আরও কঠিনতর পরিস্থিতির মুখোমুখি। কর ও ভ্যাটের নিয়মিত পরিবর্তন, অগ্রিম আয়কর ও রেগুলেটরি ডিউটির অতিরিক্ত বোঝা, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা তাদের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। হাড়ে হাড়ে ভুগছেন তারা। ঋণপত্র খোলার জটিলতা, এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রাপ্তিতে পদ্ধতিগত প্রতিবন্ধকতা এবং উচ্চ সুদ হার স্থানীয় শিল্পায়নকে যেভাবে বাধাগ্রস্ত করছে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে একটা গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিচ্ছে। এখানে বোঝাপড়ারও কিছু বিষয় আসয় রয়েছে। কারণ এলসি মার্জিন শতভাগ হবে কি না তা নির্ভর করে ব্যাংক ও ভোক্তার সম্পর্কের ওপর। কোভিড মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে মার্কিন ডলারের মূল্যের অস্বাভাবিক ওঠানামার কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অনেক দিন থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। এখন সেখানেও নতুন ধাক্কা।
বাহ্যিকভাবে নানান কথা বলা হলেও চলতি অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বেশ চ্যালেঞ্জিং। ব্যবসায়ীদের একান্ত সহযোগিতা না থাকলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব। সেখানে ব্যবসায়ীদেরই দুর্গতিতে ডুবিয়ে রাখলে আরও বিপর্যয়ের সমূহ শঙ্কা ঘুরছে। এলসি খোলা হতে সমন্বয় পর্যন্ত প্রায় তিন মাস সময় লেগে গেলে তারা বাজারজাতে যাবেন কখন? দীর্ঘসময় টাকা আটকে থাকার কারণে তাদের মূলধনেই টান পড়ছে। তার ওপর ডলারের মূল্যের অস্থিরতায় এলসির মূল্য পরিশোধে গিয়ে পড়ছেন বাড়তি ক্ষতিতে। ব্যবসার মূলধন থেকে ঋণ পরিশোধ আর কত?
ব্যবসায়ীদের ঘেরাটোপে রাখা মানে ক্রেতা-ভোক্তাদের গহ্বরে ফেলা। এ অবস্থার অবসানে হালকা কথা বন্ধ হওয়া দরকার। ভ্যাট বাড়লে জনজীবনে প্রভাব পড়বে না, টেবিলের নিচ দিয়ে টাকা দেওয়ার চেয়ে ভ্যাট দেওয়া ভালো-এ ধরনের ট্রলি কথা কাম্য একদম নয়। হালকা-চটি কথায় মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যায়, কিন্তু সমস্যা আরও পাকে।
খাদ্যপণ্যের বাজার ক্রমশ বড় হচ্ছে। এখানে বাজার তদারকির একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু বাজার তদারকিতে আগের সরকার আর বর্তমান সরকারের উদ্যোগে একই নমুনা। তা ক্রেতা, বিক্রেতা সবাইকে নীতির দুষ্টচক্রে ডুবিয়ে ছাড়ছে। বাজারের পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সরকারের কাছে নেই। বার্ষিক উৎপাদন ও সরবরাহের তথ্য সরকারের কাছে থাকলেও দৈনন্দিন চাহিদা ও জোগানের তথ্য নেই। অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশক ও সরবরাহের তথ্য স্থানীয় পর্যায়ে না থাকলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাওয়া যায়। ব্যবসায়ীদের কাছেও এ তথ্য থাকে। এ রকম একটা পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের সাথে সরকারের বোঝাপড়া নেই। বোঝাপড়া থাকলেই না সমন্বয় এবং সহযোগিতা।
সামনে রোজা। এরইমধ্যে খেজুরের দাম বেড়ে গেছে। বাজারে সয়াবিন তেল নিয়ে এক অরাজকতা। সরকারের দিক থেকে ব্যবসায়ীদের সংযোগ না বাড়লে অবস্থা আরও বেগতিক হবে। বাড়তি ভ্যাট-শুল্কসহ আনুষঙ্গিক বিষয়েও বোঝাপড়া জরুরি। ব্যবসায়ীদের ঘেরাটোপে রাখা মানে ক্রেতা-ভোক্তাদের গহ্বরে ফেলা। এ অবস্থার অবসানে হালকা কথা বন্ধ হওয়া দরকার। ভ্যাট বাড়লে জনজীবনে প্রভাব পড়বে না, টেবিলের নিচ দিয়ে টাকা দেওয়ার চেয়ে ভ্যাট দেওয়া ভালো-এ ধরনের ট্রলি কথা কাম্য একদম নয়। হালকা-চটি কথায় মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যায়, কিন্তু সমস্যা আরও পাকে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম