ধর্ষণ বাড়ছে: সাবধান হতে হবে ছেলে শিশুদের নিয়েও

16 hours ago 5
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

গত এক মাসে ‘যৌন হয়রানির শিকার ছেলেশিশু’ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি খবর চোখে পড়েছে। স্কুলে, মাদ্রাসায় এবং প্রতিবেশীর দ্বারা ছেলেশিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়টিকে লজ্জার ও বিব্রতকর মনে করে পরিবার স্বীকার করে না বা গোপন রাখে। আমাদের সমাজে মেয়েশিশুর চাইতে ছেলেশিশু ধর্ষণ বা বলাৎকারের খবর অনেক বেশি গোপন রাখা হয়। কারণ এটা এখনো ট্যাবু এবং ছেলেশিশুর জন্য অসম্মানজনক বলে মনে করা হয়।

অসংখ্য শিশু প্রতিদিন নানা ধরনের যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এরমধ্যে মেয়েশিশুর সংখ্যা বেশি হলেও ছেলে শিশুর সংখ্যাও অনেক। এ বিষয়ে কথা বলতে মানুষ এখনো স্বচ্ছন্দবোধ করে না, লজ্জা পায়। এ রকম ঘটনা যে ঘটে, তা অনেকেই স্বীকার করতে চান না, এড়িয়ে যান। এমনকি ভুক্তভোগী শিশুটিকেও বলা হয় এ কথা প্রকাশ না করতে। নিপীড়নকারী যদি পরিবারের সদস্য হয়, তার বিরুদ্ধে সাধারণত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। এগুলো প্রতিটিই হলো নিজের নিপীড়িত সন্তানের প্রতি অবিচার। এগুলো গোপন করা একধরনের অপরাধ।

অভিভাবকদের মধ্যে ধারণাই ছিল না যে, ছেলেশিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। শিশুর প্রতি যৌন অপরাধ হলে মুখ খুলতেই হবে, ট্যাবু ভাঙতেই হবে। অধিকাংশ শিশু হয়তো এই বিষয়টি ঠিকমতো বুঝেই না। আর সেই সুযোগেই অপরাধী ব্যক্তি শিশুকে ধর্ষণ, অজাচার, (ইনসেস্ট), ওরাল সেক্স, পর্নোগ্রাফি, যৌনাঙ্গে বা মলদ্বারে কোন কিছু প্রবেশ করানো, শিশুর নগ্ন ছবি প্রদর্শন অথবা ছবি তোলার মতো কাজগুলো করিয়ে নেয়। এগুলো সবই যৌন হয়রানি।

আমরা আশা করবো সরকার ধর্ষণের দ্রুত বিচার করতে গিয়ে চট করে এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না, যাতে মানুষ এর অপব্যবহার করার সুযোগ পায়। সেই সাথে ছেলেশিশুর প্রতি যৌনহয়রানি ও ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। সমাজে এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে এবং অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। মেয়ে ও ছেলেশিশু কেউই নিরাপদ নয় ধর্ষণকারীর হাত থেকে।

বাংলাদেশে শতকরা ৭৫ ভাগ শিশুর যৌন নিপীড়ক পরিবারের ঘনিষ্ঠজন। অনেক দিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন পুরুষ বা নারীর যৌন ক্ষুধার শিকার হয় ছেলেশিশুরা। সমকামী ও বিকৃত রুচির মানুষেরাও ছেলে শিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন চালাতে পারে বা চালায়।

শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে সমাজে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে এবং আমরা অধিকাংশ অভিভাবক সেই ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করেই শিশুর উপর যৌন হয়রানির বিষয়টিকে বিচার করি। অনেকেই মনে করি শুধু মেয়েশিশু ও নারীরাই যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়। বাংলাদেশে প্রতি চার জন মেয়েশিশুর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। কিন্তু আমরা কি জানি যে মেয়েশিশু ও নারীর পাশাপাশি ছেলেশিশু ও পুরুষরাও যৌন হয়রানি ও বলাৎকার বা ধর্ষণের শিকার হয়? প্রতি ছয় জন ছেলেশিশুর মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় একজন।

শুধু পুরুষের দ্বারাই শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হয়, তা কিন্তু নয়। শিশুরা কখনো কখনো নারীর হাতেও যৌন হয়রানির শিকার হয়। নারীদের বিরুদ্ধেও আছে যৌন হয়রানির অভিযোগ। শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বাড়িতে, আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুদের বাড়িতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ছাত্রাবাসে।

অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে যৌন হয়রানির শিকার শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে তিনি যৌন হয়রানি বিষয়ে ক্লিনিক্যাল গবেষণা করেছেন। তাঁর এই গবেষণায় শিশুদের যৌন হয়রানি বিষয়ে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। তাতে দেখা যায়, শতকরা ৭৫ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে এবং ছেলে শিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। (ডয়েচে ভেলে)
আমাদের পরিবার ও সমাজে মেয়েশিশুকে অনেক বাবা মা সাবধান করেন বা চোখে চোখে রাখেন। কোনটা গুড টাচ, কোনটা ব্যাড টাচ তাকে তা জানানো হয়। কিন্তু ছেলেশিশুর ব্যাপারে আমরা একেবারে উদাসীন। একটি ছেলে শিশুকে কেউ চুরি বা অপহরণ করতে পারে, কিন্তু তাকে বলাৎকার করবে, এটা তারা ভাবেন না। বাংলাদেশের সমাজে এটা খুব অপরিচিত বিষয়। কাজেই এই ট্যাবুটাই ভাঙতে হবে প্রথমে। প্রচার করতে হবে, সাবধান হতে হবে যে, শুধু মেয়ে শিশুকেই যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ করা হয় না, ছেলে শিশুকেও করা হয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়টি জবাবদিহিতার সংস্কৃতির আওতায় আনতে হবে। বাবা মা বিশ্বাস করে তাদের শিশুকে শিক্ষাঙ্গনে পাঠান, সেখানে যদি এইভাবে নিপীড়নের শিকার হয়, তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। আমরা পরপর বেশ কয়েকটি খবর পেয়েছি যে শিক্ষাঙ্গনে ছেলেশিশুরা নানাভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। যৌন নিপীড়ক ব্যক্তি এমন বেশে শিশুর সামনে আসে, যখন শিশু বা তার পরিবার বুঝতেই পারে না যে তাদের সাথে কী ঘটতে পারে বা কী ঘটতে যাচ্ছে। তাকে শিশু বা শিশুর পরিবার বিশ্বাস করে। এই লোকগুলো প্রায়ই রক্ষকের ভূমিকায় এসে ভক্ষক হয়ে যায়।

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন অনেক ক্ষেত্রে একটা শিশু নিজে বুঝতে পারে না যে কোনটা নির্যাতন। আবার শিশু তার মা-বাবাকে বলতে না পারার পেছনে আরেকটা বড় কারণ হলো বাবা-মায়েরা সাধারণত শিশুর কথা বিশ্বাস করতে চান না। নির্যাতনের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে কখনো বাচ্চাকে দায়ী করা যাবে না। তাকে মানসিক সমর্থন করতে হবে, তার সামনে এই ঘটনা নিয়ে বার বার আলোচনা করা বা কান্নাকাটি করা যাবে না।

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীনে না থাকার কারণে কওমি মাদ্রাসায় ঠিক কী হচ্ছে এবং কীভাবে এখানে নিপীড়ন বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়। কওমি মাদ্রাসাসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা এতদিন ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হলেও এখন সেইসব ঘটনা ক্রমশ সবার সামনে চলে আসছে।

শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক গণমাধ্যমকে বলেছেন, আগে শুধু আবাসিক স্কুল ও মাদ্রাসায় ছেলেশিশুরা ধর্ষণের শিকার হতো বলে অভিযোগ পাওয়া যেতো। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা, এখন এই ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে শ্রমজীবী বা পথ-শিশুরা প্রচুর ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। যেমন লঞ্চ বা বাস টার্মিনাল, ফুটপাত, মার্কেটে। এসব জায়গায় আশ্রয়হীন মানুষ মানুষ রাত্রি যাপন করে সেসব জায়গায় এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ।

দরিদ্র ঘরের অনেক শিশু কওমি মাদ্রাসায় থাকা খাওয়ার সুবিধা পায় বলে এখানে পড়তে আসে, কাজেই তাদের উপর নির্যাতন করা হলে, তাদের পক্ষে মুখ খোলার কেউ থাকেনা। সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে সাধারণ স্কুলে ও মাদ্রাসায় কী হচ্ছে এবং কী হতে পারে। সময় এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধে একটা সামগ্রিক অ্যাপ্রোচ নেয়ার।

যৌন নির্যাতনের শিকার ওই ছেলেশিশুরা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং হাসপাতালে নেয়া হয়, তখনই বিষয়গুলো সামনে আসে। এদেরকে যারা দিনের পর দিন ধর্ষণ করে, তারা এদের শিক্ষক, গুরুজন, ভাই ও আত্মীয়। তারা এদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখে। এমনকি পরিবারের সদস্যরাও পাত্তা দেয় না ছেলেশিশুর এই অভিযোগকে।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ছেলেশিশুর প্রতি যৌন হয়রানি ও বলাৎকার প্রসঙ্গে কোন স্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়নি। তাই আইনজীবী ও পুলিশের কাছেও এটা পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে রেপ বা যৌন নির্যাতনের যে সংজ্ঞা, সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী ও মেয়েদের কথাই বলা আছে। আইনের এই দিকটার সুযোগ গ্রহণ করছে অপরাধীরা। সেইসাথে ছেলেশিশুর প্রতি যৌন নিপীড়নের বিষয়টিকে আর এড়িয়ে না গিয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে।

এইবার দৃষ্টি ফেরাই মেয়েশিশু ও নারী ধর্ষণের উপর। ধর্ষণ এদেশে নতুন নয়। বছরের পর বছর শিশু ও নারীর উপর এই নিপীড়ন চলছে। আইন আছে কিন্তু এর প্রয়োগ হালকা। অনেকগুলো আইনী ও সামাজিক দুর্বলতার কারণে রেপ ভিকটিম বিচার পায় না। এরমধ্যে সবচাইতে বড় কারণগুলো হচ্ছে মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিবারের ইতস্তত মনোভাব, তাদের ভয় ও দারিদ্র, পুলিশের অনাগ্রহ, সমাজের চাপ এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা।
প্রশাসন ও সমাজ যে নারী ধর্ষণ নিয়ে খুব বিচলিত নয়, এর প্রমাণ দিয়েছিলেন ডিএমপি কমিশনার। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার গণমাধ্যমে 'ধর্ষণ' শব্দটি ব্যবহার না করে, এর বদলে 'নারী নির্যাতন' বা 'নারী নিপীড়ন' শব্দ ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "আমি দুটো শব্দ খুব অপছন্দ করি, এর মধ্যে একটি হলো ধর্ষণ। আপনাদের কাছে অনুরোধ, এটা ব্যবহার করবেন না। আপনারা 'নারী নির্যাতন' বা 'নিপীড়ন' বলবেন। আমাদের আইনেও নারী ও শিশু নির্যাতন বলা হয়েছে। যে শব্দগুলো শুনতে খারাপ লাগে, সেগুলো আমরা না বলি।"

ওনার এই বক্তব্যে সবাই প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও ইতিবাচক ব্যাপার হচ্ছে 'ধর্ষণ' শব্দ পরিহার নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের করা মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। সেই বিবৃতিতে বলা হয়, 'ধর্ষণ শব্দটি পরিহার নিয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর করা মন্তব্যে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। আট বছর বয়সী বা ৮০ বছর বয়সী, যার সঙ্গেই হোক না কেন ধর্ষণ ধর্ষণই। এমন জঘন্য অপরাধকে অবশ্যই যথাযথভাবে উল্লেখ করতে হবে।' ডিএমপি কমিশনার 'ধর্ষণ' শব্দটি ব্যবহার না করার অনুরোধের মাধ্যমে বাস্তবে ধর্ষকের পক্ষ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

পুলিশের কমিশনার সাহেব তার অদ্ভুত অনুরোধ থেকে সরে এসেছেন। উনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। এজন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। এদিকে দ্রুত বিচার আদালতে ধর্ষণের বিচার হবে বলে সরকারের উপদেষ্টারা কথা বলেছেন। তবে আইন উপদেষ্টা অত্যধিক উত্তেজিত হয়ে যে বলেছেন ধর্ষণ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে আদালত চাইলে ডিএনএ টেস্ট ছাড়াই বিচার করতে পারবেন, এটাও তো কাজের কথা হলো না।

জনগণের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া খুব ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেটা যেন কোনোভাবেই হঠকারী না হয় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। ডিএনএ টেস্ট করা না করা হলে নিরীহ মানুষও বিপদে পড়তে পারেন। যখন দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন হয়েছিল, তখন অনেকেই মন্দ উদ্দেশ্যে এই আইন ব্যবহার করেছিল এবং এখনো করে।
আমরা আশা করবো সরকার ধর্ষণের দ্রুত বিচার করতে গিয়ে চট করে এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না, যাতে মানুষ এর অপব্যবহার করার সুযোগ পায়। সেই সাথে ছেলেশিশুর প্রতি যৌনহয়রানি ও ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। সমাজে এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে এবং অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। মেয়ে ও ছেলেশিশু কেউই নিরাপদ নয় ধর্ষণকারীর হাত থেকে।

১৮ মার্চ, ২০২৫

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article