ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS
আওয়ামী লীগ সরকারের পলাতক এমপি-মন্ত্রীদের আমদানি করা বিলাসী গাড়িতে এবার চোখ পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্মকর্তাদের। নিলামে কাঙ্ক্ষিত দর মিলছে না গাড়িগুলোর। প্রতিটি প্রায় ১০ কোটি টাকার এসব গাড়ির মধ্যে পাঁচটি কেনার অনুমতি চেয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তারা গাড়িগুলো কিনতে চান মাত্র পৌনে তিন কোটি টাকায়।
চিঠিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে প্রতিটি জিপ গাড়ি কিনতে আনুমানিক দুই কোটি ৮০ লাখ টাকার প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা হলেও এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট শাখা কিছুই জানে না বলে দাবি। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস না জানলেও ঊর্ধ্বতন লেভেল থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন পেলেই তারা এসব গাড়ি কিনবেন।
বিগত সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের নামে শুল্ক সুবিধায় আমদানি করা ২৪টি ল্যান্ড ক্রুজার জিপ গাড়ি শেষমেশ খালাস না নেওয়ায় প্রথমবার নিলামে তুলে কাঙ্ক্ষিত দর না পেয়ে বিক্রি করতে ব্যর্থ হয় চট্টগ্রাম কাস্টম। তবে প্রায় ১০ কোটি টাকা দামের এসব গাড়ি বন্দর কর্মকর্তাদের সরকারি কাজে ব্যবহারের আগ্রহ দেখানোকে ভালোভাবে দেখছেন না অনেকে।
আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি। তারপরেও তারা এসব গাড়ি কিনতে চাইলে নিলামে অংশ নিতে হবে। ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকার নিচে তো আমরা তাদের কাছে গাড়ি বিক্রি করতে পারবো না। সেক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আদেশ নিয়ে আসতে হবে।- চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপ-কমিশনার (প্রিভেন্টিভ) মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারি মাসে ২৪টি বিলাসবহুল ল্যান্ডক্রুজার জিপ নিলামে তোলে চট্টগ্রাম কাস্টম। শুল্কমুক্ত সুবিধায় খালাসের জন্য আনা প্রতিটি গাড়ির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩ হাজার ৮৯৯ টাকা। এর মধ্যে নিলামের বিধি মোতাবেক প্রথমবার নিলামে নির্ধারিত দরের ৬০ শতাংশ কিংবা তার বেশি কাঙ্ক্ষিত দর নির্ধারণ করা হয়। সেই হিসেবে প্রতিটি গাড়ির ন্যূনতম দর ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা না পাওয়ায় গাড়িগুলো প্রথম নিলামে বিক্রি করেনি চট্টগ্রাম কাস্টম। গাড়িগুলোর মধ্যে বিগত দ্বাদশ সংসদের ২৩ জন এমপি-মন্ত্রীর। অন্যটি একাদশ জাতীয় সংসদের প্রয়াত এমপি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নামে আমদানি করা।
আরও পড়ুন
- আ’লীগের এমপি-মন্ত্রীদের আমদানি করা গাড়ির নিলামে দর হাঁকলেন কারা?
- সাড়ে ১০ কোটির গাড়ি সোয়া কোটিতে আনলেন সাকিব, আটকে গেলো সুমনেরটা
- নিলামে দুই বছরে আড়াইশ কোটি টাকা আয় চট্টগ্রাম কাস্টমসের
- মোংলায় নিলামে উঠছে ৪০ রিকন্ডিশন গাড়ি
জাপানে প্রস্তুত করা এসব গাড়ির মধ্যে ৩৩৪৬ সিসির ২১টি ২০২৪ সালের তৈরি, একটি ২০২২ সালের এবং ৩৩৪৫ সিসির দুটি ল্যান্ডক্রুজার তৈরি হয় ২০২৩ সালে। প্রথম নিলামে শুধু দুটি জিপের প্রতিটি সর্বোচ্চ ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা দর ওঠে। খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য এস এম কামাল হোসাইন এবং নীলফামারী-৩ আসনের সাদ্দাম হোসেন পাভেলের আমদানি করা ৩৩৪৬ সিসির ল্যান্ডক্রুজার জেডএস মডেলের গাড়ি দুটি আলাদাভাবে সর্বোচ্চ দর ডাকেন চট্টগ্রামের সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ।
৫ গাড়ি পেতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিঠি
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত ৫ মার্চ কাস্টমসের নিলামযোগ্য পাঁচটি ভিআইপি জিপ কেনার অনুমতি চেয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত ওই চিঠির একাংশে উল্লেখ করা হয়, ‘কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিলামযোগ্য পাঁচটি ভিআইপি জিপ/কার (ল্যান্ডক্রুজার প্রাডো, মিতসুবিশি পাজেরো/এনি আদার সুইটেবল কার) কেনার বিষয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সবশেষ নিলামের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি জিপ কেনায় আনুমানিক ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে মর্মে অবহিত করা হয়েছে।’ ওই চিঠির শেষাংশে, কাস্টমস কর্তৃপক্ষের রিজার্ভ মূল্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কেনার অনুমতির অনুরোধ করা হয়।
যা বলছে বন্দর ও কাস্টম
এ বিষয়ে কথা হলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপ-কমিশনার (প্রিভেন্টিভ) মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাবেক এমপিদের নামে শুল্ক সুবিধায় আনা জিপ গাড়ি বিক্রির বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাস্টমসের কোনো আলাপ হয়নি। আমার জানা মতে, কোনো গাড়ির দরও বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি। এ ধরনের কোনো দর দেওয়া হয়েছে কি না তা সংশ্লিষ্ট শাখা (নিলাম শাখা) বলতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘শুল্ক সুবিধায় আমদানি হলেও খালাস না হওয়া ২৪ ল্যান্ডক্রুজার নিলামে তোলা হয়। প্রত্যেকটি গাড়ির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আইন অনুযায়ী প্রথম নিলামে নির্ধারিত দরের কাঙ্ক্ষিত দর ছিল ৬০ শতাংশ। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দর না পাওয়ায় এসব গাড়ি বিক্রি করা হয়নি।’
শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হওয়া বেশ কয়েকটি জিপ গাড়ি কাস্টমস নিলামে তুলেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যবহারের জন্য এসব গাড়ি থেকে পাঁচটি জিপ কেনার অনুমতি চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।-বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক
বন্দর কর্তৃপক্ষের গাড়ি কেনার আগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি। তারপরও তারা এসব গাড়ি কিনতে চাইলে নিলামে অংশ নিতে হবে। যদি নিলামে অংশ না নেন, তাহলে তো আমরা সরাসরি তাদের (বন্দর) কাছে গাড়ি বিক্রি করতে পারবো না। তাছাড়া একেকটি গাড়ির কাঙ্ক্ষিত দর আসে ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকার নিচে তো আমরা তাদের কাছে গাড়ি বিক্রি করতে পারবো না। সেক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আদেশ নিয়ে আসতে হবে। অথবা বন্দরের জন্য এনবিআর থেকে বিশেষ আদেশ করতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমসের নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার মো. সাকিব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিলাম শাখা থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষকে নিলামের জিপ বিক্রির বিষয়ে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। দরও দেওয়া হয়নি।’
তবে এ ব্যাপারে বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হওয়া বেশ কয়েকটি জিপ গাড়ি কাস্টম নিলামে তুলেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যবহারের জন্য এসব গাড়ি থেকে পাঁচটি জিপ কেনার অনুমতি চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা গাড়ির মূল্য দুই কোটি ৮০ লাখ টাকার বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ অবগত না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম কাস্টম অবগত না হলে আরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এনবিআর থেকে থেকে অবগত হবেন।’
তিনি বলেন, ‘এমনিতে নিলামের এসব গাড়ি বন্দর কর্তৃপক্ষ সরাসরি কিনতে পারবে না। এখন প্রথমে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে এনবিআর থেকে অনুমতি চাওয়া হবে। এনবিআরের আদেশ হলেই এসব জিপ গাড়ি কেনা হবে।’
সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের শুল্ক সুবিধায় আনা এসব বিলাসী গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে বন্দর কর্মকর্তাদের আগ্রহের সমালোচনা করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান, আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এসব গাড়ি একমাত্র ব্যাংক লুটেরা ছাড়া কেউ ব্যবহার করতে পারার কথা নয়। যেহেতু সাবেক এমপিরা এসব গাড়ি নেননি, এখন এসব গাড়ি বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য কেনার আগ্রহ দেখানো অন্যায়। কারণ এগুলো বিলাসী গাড়ি। একেকটা গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও প্রচুর। বন্দরের টাকা মানে রাষ্ট্রের টাকা।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যারা কর্মকর্তা, তারা আমাদের দেশের সাধারণ আমজনতার অংশ। তারা কেন এসব বিলাসী গাড়ি ব্যবহারের জন্য চাইবেন। জনগণের অর্থে (টাকায়) এসব লোভ একেবারেই অন্যায় এবং অপরাধমূলক।- সুজন চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যারা কর্মকর্তা, তারা আমাদের দেশের সাধারণ আমজনতার অংশ। তারা কেন এসব বিলাসী গাড়ি ব্যবহারের জন্য চাইবেন। জনগণের অর্থে (টাকায়) এসব লোভ একেবারেই অন্যায় এবং অপরাধমূলক। আমরা মনে করি, এসব গাড়ি কেনার আগ্রহ বন্দর কর্তৃপক্ষের একটি ভ্রান্ত ও অন্যায় সিদ্ধান্ত। তারা অন্যদিকে লুটপাট করেছে বলেই বিলাসী গাড়ি ব্যবহারে চোখ পড়ছে। তা না হলে বন্দর কর্মকর্তাদের এসব গাড়ি ব্যবহারের মানসিকতা হবে কেন?’
এ আইনজীবী বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে তদবির করলে হয়তো অনুমতিও পেয়ে যাবেন। কারণ সব জায়গায়ই একই চিত্র। তারপরেও বন্দরের অচিরেই এ সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।’
যাদের নামে আমদানি করা বিলাসী ২৪ ল্যান্ডক্রুজার
ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল, রংপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আসাদুজ্জামান, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ঢাকা-১৭ আসনের মোহাম্মদ আলী আরাফাত, চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক স্বতন্ত্র এমপি ও সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মোতালেব, সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের জান্নাত আরা হেনরী, গাইবান্ধা-২ আসনের শাহ সরোয়ার কবির, বগুড়া-৫ আসনের মজিবর রহমান মজনু, খুলনা-৩ আসনের এস এম কামাল হোসাইন, জামালপুর-৫ আসনের মো. আবুল কালাম আজাদ, নেত্রকোনা-৪ আসনের সাজ্জাদুল হাসান, গাজীপুর-৫ আসনের আখতারুজ্জামান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান, ঢাকা-১৯ আসনের সাইফুল ইসলাম, ময়মনসিংহ-১১ আসনের মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ, যশোর-২ আসনের মোহাম্মদ তৌহিদুজ্জামান, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য রুনু রেজা (আসন-১২), শাম্মি আহমেদ (আসন-১৭), নাট্য অভিনেত্রী তারানা হালিম (আসন-৩১), সানজিদা খানম (আসন-৩২), নওগাঁ-৩ আসনের সুরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, ময়মনসিংহ-৭ আসনের এ বি এম আনিছুজ্জামান, নীলফামারী-৩ আসনের সাদ্দাম হোসেন পাভেল এবং একাদশ সংসদের প্রয়াত সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তিনি ২০২২ সালের ১১তম জাতীয় সংসদের সদস্য থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন। যে কারণে গাড়িটি বন্দর থেকে খালাস নেওয়ার সুযোগ হয়নি।
এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএস