ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS
আমার বাসায় কাজ করেন যে আপা, তার খানায় তিনটি মোবাইল ফোন তিন জনের– আপা, তার রিকশাচালক স্বামী এবং স্কুল পড়ুয়া ছেলের হাতে। অধুনা তাদের মাথায় টাচ ফোনের চাহিদা উঁকিঝুঁকি মারছে ।
দুই.
বলা বাহুল্য, বেশ অল্প সময়ের মধ্যে এবং দ্রুততার সাথে বাংলাদেশে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) বিস্তার লাভ করতে সমর্থ হয় । টাকার অঙ্কে ২০১৫ সালের জুলাই মাসের প্রায় তেরো হাজার কোটি টাকা থেকে প্রায় আড়াইগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালের জুলাইতে দাঁড়ায় প্রায় বত্রিশ হাজার কোটি টাকার সেবা । মোট কথা, এমএফএস আর্থিক বাজার তাৎপর্যপূর্ণভাবে গভীরতর করেছে, এবং তার সাথে যুক্ত আছে বিভিন্ন পণ্য পরিবেষ্টিত সেবা। প্রথম দিকে ব্যক্তি-ব্যক্তি আর্থিক লেনদেন প্রাধান্য পেলেও অধুনা বেতন, স্কুলের বৃত্তি প্রদান এবং অনলাইন আর অফ লাইনে বাণিজ্যিক দেনাপাওনা , বিভিন্ন বিল এবং হকারের পাওনা পরিশোধ সবই মোবাইল ফোনের কল্যাণে বেশুমার চলছে ।
বাংলাদেশের বাজারে অনেক এমএফএস সেবা দিয়ে গেলেও কিন্তু মাত্র দুটো এমএফএস বাজারের সিংহভাগ শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে; এখন পর্যন্ত ‘বিকাশ’ নামে প্রতিষ্ঠানটি বিকশিত হয়ে বাজারের নেতৃত্বে আসীন। ব্র্যাক ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি হিসেবে বিবেচিত ‘বিকাশ’ ও ডাচ – বাংলা ব্যাংকের ‘রকেট’ (শেয়ার ৩৮ ভাগ) এই দুই প্রভাবশালী সেবাদাতা নিয়ন্ত্রণ করে বাজারের ৯৪ শতাংশ সেবা। বলতে দ্বিধা নেই যে সাধারণ আলোচনায় এখন এমএফএস বলতে মূলত বিকাশকে বুঝায় যার আক্ষরিক অর্থ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা পাঠানো এবং পাওয়া।
খানা-ভিত্তিক সমীক্ষায় জানা যায় , গ্রামীণ কমিউনিটির সেবায় নিয়োজিত আছে মূলত তিনটি এমএফএস জোগানদার যথা বিকাশ, রকেট এবং সিউরক্যাশ। যদিও গ্রামীণ খানার প্রায় শতভাগের অন্তত একটা মোবাইল ফোন আছে, কিন্তু এমএফএস এ হিসাব আছে মাত্র ৩৮ শতাংশের । মোবাইল ফোন আছে এমন খানার ৬৮ শতাংশ কোনো না কোনো এমএফএস ব্যবহার করে এবং এদের অর্ধেকের মতো সংযোগ রাখে বিকাশের সাথে। গ্রামীণ বাংলার সকল ব্যক্তির ১৪ শতাংশ টাকা লেনদেনে বিকাশ ব্যবহার করে (১৬ শতাংশ পুরুষ , ১২ শতাংশ নারী )।
তিন.
যাই হোক , প্রাপ্ত বা পাঠানো টাকার তিন-চতুর্থাংশ নিয়ে সিংহভাগ খরচ হয় ভোগে, স্বাস্থ্যে ৪ শতাংশ এবং শিক্ষায় ৬ শতাংশ । বিকাশ যেহেতু ধনী-গরীব নির্বিশেষে জনপ্রিয় মাধ্যম, বিশেষত গরিবের ভোগ মসৃণে তথা দারিদ্র্য হ্রাসে এর ভূমিকা ব্যাপক বলেই অনুমান করা যায়। সকল এমএফএস এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ প্রাপ্ত হয় জেলার বাইরে থেকে (নারী ৭০ শতাংশ, পুরুষ ৬৪ শতাংশ)।
প্রায় এক -তৃতীয়াংশ খানা বিকাশের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেছে গড়পড়তা ৯ বার, বছরে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। সব এমএফএস এর চিত্র মোটামুটি একই হবে যেখানে বিকাশের অনেকটা অপ্রতিরোধ্য আধিপত্য বিদ্যমান। কী কী উপাদানের উপর গ্রামীণ খানাগুলোর এমএফএস এ অংশগ্রহণ নির্ভর করে?
জানা যায়, খানা প্রধান পুরুষ হলে বিভিন্ন আর্থিক এমএফএস ও অন্য এক সেবায় হিসাব খোলার সুযোগ গ্রহণের সম্ভাবনা বেশি থাকে; হিসাব খোলার ব্যাপারে শিক্ষার স্তরও একটা নিয়ামক; তেমনি নিয়ামক খানা প্রধানের বয়স ব্যাংক অথবা বিকাশে হিসাব খোলায়। অন্যদিকে, ঘরবাড়ি বিদ্যুৎ, সম্পদ লভ্যতা নির্ধারণ করে হিসাব খোলা হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত। মজার কথা, ভূমিসম্পদ বেশি যাদের তাদের ব্যাংক বা বিকাশে হিসাব খোলার সম্ভাবনা কম অথচ ভূমি– বহির্ভূত সম্পদের মালিকানা ইতিবাচক প্রভাব রাখে হিসাব খুলতে।
চার.
এটা সত্যি যে মোবাইল ফোনের মালিকানা এমএফএস হিসাব খোলার জন্য দরকার তবে মোবাইল ফোনের ভেতর স্মার্ট ফোনের চাহিদা অধিকাংশ এমএফএস গ্রাহকের। উদাহরণস্বরূপ, নিয়মিত ফোনের ২৩ শতাংশ পয়েন্টের বিপরীতে, খানায় একটা স্মার্ট ফোন থাকলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা বৃদ্ধি ঘটে ২৯ শতাংশ পয়েন্ট । একইভাবে, স্মার্ট ফোনের মালিকানা বিকাশের অ্যাকাউন্ট খোলার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে ২২ শতাংশ পয়েন্ট যেখানে নিয়মিত ফোন করে ১০ শতাংশ পয়েন্ট ।
এমএফএস বিভিন্নভাবে খানার কল্যাণ বৃদ্ধি করে। প্রথমত, দক্ষ, দ্রুত এবং নিরাপদ অর্থ হস্তান্তরের মাধ্যমে বিকাশের মতো এমএফএস সেবা খানার সম্পদ নিয়ন্ত্রণে দক্ষতা আনয়ন করত খানার আয়, ভোগ এবং অন্যান্য নির্দেশকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। দুই. খুব দ্রুত অর্থ আদান -প্রদানে সাহায্য করার মাধ্যমে এমএফএস খানার ধাক্কা বা শক জনিত সমস্যা মোকাবেলায় সক্ষম করে তুলে। তিন. বিকাশের মতো এমএফএস সনাতন পদ্ধতিতে যেমন লোক মারফত কিংবা কুরিয়ারে অর্থ হস্তান্তরের বিপরীতে সুলভে বিনিময় ঘটাতে পারে এবং এতে কম সময়ের ভেতর অধিক লেনদেন সম্পাদন সম্ভব হয়। তবে গ্রামে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের এজেন্টের উপস্থিতি, যেমন বিকাশের, এর ব্যবহার বৃদ্ধি ঘটায় প্রায় পাঁচ শতাংশ পয়েন্ট। অবশ্য অন্যান্য এমএফএস এর জন্য এই সম্পর্ক খানিকটা দুর্বল। এবং বলা বাহুল্য, বিকাশের কারণে খুব দ্রুত লেনদেন খানাগুলোকে ধাক্কা সামলাতে সাহায্য করে যা আবার ঝুঁকি– অংশীদারিত্বে আয় ও ভোগের উঠানামা হ্রাস করে।
এমএফএস খাতে প্রধান ভূমিকায় আছে নারী। শ্রম বাজারে বিশেষত শহরের কলকারখানা কিংবা খানায় তাদের উপস্থিতি, প্রেরক এবং প্রাপক উভয় কারণে, এমএফএস ব্যবহার বৃদ্ধি করেছে। নারীদের একটা বড় অংশ বাড়িতে বসে শহর থেকে পাঠানো অর্থ হাতে পায়। এবং এতে করে তাদের ক্ষমতায়ন, বিশেষ করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার সিদ্ধান্তে, বৃদ্ধি পায়। অতএব বলা চলে যে, বিকাশের মতো এমএফএস শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর শ্রম -বাজার ভিত্তিক উপার্জন, অন্যান্য কাজে অংশগ্রহণ এবং খানার সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
পাঁচ.
কিছুকাল আগেও, দুতিন বছর আগে, বিকাশের গ্রাহকের সংখ্যা ছিল প্রায় চার কোটি, যাদের মধ্যে সক্রিয় প্রায় দুই কোটি। সারা বাংলাদেশে ২২০,০০০ এজেন্ট নিয়ে বিকাশের বার্ষিক লেনদেন ২৭ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশের সমুদয় অর্থনীতির ১১ শতাংশ (২০১৭ সালের ২৫০ বিলিয়ন ডলার সাপেক্ষে)। মূলত অর্থনীতিতে বিকাশ যে ভূমিকা রাখছে তা হল লেনদেনে বিনিময় ব্যয় হ্রাস করে অর্থনীতির দক্ষতা বৃদ্ধি। গ্রাহকের নিট লাভ আসে ৪ শতাংশ এবং ২৭ বিলিয়ন ডলারের সমগ্র অর্থনীতিতে উপকারিতার পরিমাণ প্রায় ৮৭ বিলিয়ন টাকা বা ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার । যদি জিডিপি ধরা হয় ২৫০ বিলিয়ন ডলার, তখন অর্থনীতিতে বিকাশের কর্মকাণ্ডের অবদান দাঁড়ায় ০.৫ শতাংশ । বলা বাহুল্য, বর্তমান জিডিপির হিসাবে তা প্রায় এক শতাংশের বেশি হবে।
মোট কথা বিকাশ (বাজারের অর্ধেক শেয়ার ) এবং অন্যান্য এমএফএস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। মানুষ যেমন প্রতিনিয়ত একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে, সামাজিক খাতে উন্নতি ঘটছে, বিনিময় ব্যয় হ্রাস করে একটা দক্ষ এবং প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সরকারের উচিত হবে যথাযথ নীতিমালার মাধ্যমে এমএফএস উৎসাহিত করা যাতে ভুঁইফোঁড় এমএফএস টাকা পাচারে লিপ্ত হতে না পারে, যাতে একটা প্রতিযোগিতামূলক কাঠামোর উপর এমএফএস দাঁড়াতে পারে ।
আগে একজন রিকশা চালক মাসের শেষে কুড়িগ্রাম গ্রামের বাড়ি গিয়ে পরিবারের কাছে টাকা দিতেন। যাওয়া-আসায় তার প্রায় তিন দিনের মজুরি নাশ। আর এখন কয়েক মিনিটের মধ্যে টাকা পৌঁছে যায় তার পরিবারের কাছে। এমএফএস ধনী-গরীব নির্বিশেষে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ; বিকশিত হোক বিকাশ এবং অন্যান্য এমএফএস ।
অন্তত মোবাইল সেবার ক্ষেত্রে সম্ভবত কেউ বলবে না, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা।’ বিকৃত উন্নয়ন বয়ানের মধ্যে সত্য এটা যে বাংলাদেশ এমএফএস সেবায় অনেক দূর এগিয়েছে, হয়তো আরও অত্যাধুনিক এবং সময়ের চাহিদা পূরণে তৈরি হবে ভবিষ্যতের জন্য।
লেখক : সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থনীতিবিদ। কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস