ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশে-বিদেশে ‘রাতের ভোট’ হিসেবে আলোচিত। এবার সেই ভোটের কুশীলবদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই ধারাবাহিকতায় ওই সময় নির্বাচন কমিশনে (ইসি) সচিবের দায়িত্ব পালন করা হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। দুদকের একাধিক সূত্র জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করে।
হেলালুদ্দীন, তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্টকার্ড ছাড়াও ইসিতে হেলালুদ্দীনের কর্মকাল ও কার্যক্রমসহ যাবতীয় তথ্য চেয়ে ইসিসহ সরকারের একাধিক দপ্তরে চিঠি দিয়েছে দুদক। পাশাপাশি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার বানানোর অভিযোগও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
ভোটার তালিকায় থাকা ৫৫ হাজার ৩১০ জন রোহিঙ্গা নাগরিকের নাম, বাবার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে ইসি বা অন্য সংস্থা থেকে কোনো তদন্ত হলে তদন্ত প্রতিবেদনের সত্যায়িত ফটোকপিও চেয়েছে দুদক।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর ২৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন হেলালুদ্দীন আহমদ।
অভিযোগ আছে ভোটের আগের দিন অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর রাতে ব্যালটে ভোট ভর্তি করা হয়। সিংহভাগ কেন্দ্রে বেশি ভোট দেখানো ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক এই সিনিয়র সচিবের অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজতে দুদকের একজন সহকারী পরিচালককে অনুসন্ধানী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। গত সপ্তাহেই হেলালুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একই চিঠি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও পাঠিয়েছে দুদক। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক এই সদস্যের দুর্নীতির প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
শেখ হাসিনা পতনের পর রাতের ভোটখ্যাত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। এ ভোটের কুশীলবদের অনেকেই এখনো ধরাছোয়ার বাইরে। অনেকেই গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি। ভোটের মাঠে ‘অনিয়ম’ করা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। দুদকের একটি দল অনুসন্ধান করছে। সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের আয়কর নথি।
ওই নির্বাচনের নানান অনিয়ম, ভোট কারচুপি ও আর্থিক লেনদেন নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা তাদের কাজ করছেন। অনুসন্ধান শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।- দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন
এ ব্যাপারে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ওই নির্বাচনের নানান অনিয়ম, ভোট কারচুপি ও আর্থিক লেনদেন নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা তাদের কাজ করছেন। অনুসন্ধান শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৯টি দল অংশগ্রহণ করে। ওই নির্বাচনে ২৯৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জোট ২৬৬টি আসন পায়। জাতীয় পার্টি ২২টি, বিএনপি সাতটি ও অন্যান্য দল চারটি আসন পায়। ওই ভোটে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটে। অভিযোগ আছে ভোটের আগের দিন অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর রাতে ব্যালটে ভোট ভর্তি করা হয়। সিংহভাগ কেন্দ্রে বেশি ভোট দেখানো ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ নিয়ে সেই সময় একাধিক গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের পতনের পরে এ ভোটের অনিয়ম নিয়ে দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর রাতে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের চার তলার পেছনের কনফারেন্স রুমে ওই গোপন বৈঠক হয়। পরে হেলালুদ্দীন আহমদ চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজেও একই ধরনের গোপন বৈঠক করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
হেলালুদ্দীনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে অংশ নেওয়ার অভিযোগ করে বিএনপি। ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর রাতে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের চার তলার পেছনের কনফারেন্স রুমে ওই গোপন বৈঠক হয়। পরে হেলালুদ্দীন আহমদ চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজেও একই ধরনের গোপন বৈঠক করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ আছে ইসি সচিবের দায়িত্বে থাকাকালীন হেলালুদ্দীনের ছিল সিক্রেট পাওয়ার হাউজ। অদৃশ্য কলকাঠি নাড়তেন তিনি। অবসরে যাওয়ার আগের দিন বিদেশে প্রশিক্ষণ, রোহিঙ্গাদের ভোটার বানানো, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ লোপাট, নির্বাচনে অনিয়ম, ইসিতে প্রশিক্ষণের নামে অর্থ লোপাটের অভিযোগ রয়েছে হেলালুদ্দীনের নামে।
হেলালুদ্দীন আহমদ ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে ২০২২ সালের মে মাসে অবসরে যান তিনি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের একান্ত অনুগত এই আমলা ২০২৩ সালে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হন এবং গত বছরের ৮ অক্টোবর পদত্যাগ করেন।
হেলালুদ্দীন আহমদ কর্মকর্তা ১৯৮৮ সালে সিভিল সার্ভিসের (প্রশাসন) ক্যাডার হিসেবে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি সহকারী কমিশনার, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর, উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী, ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ইসি ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালনকালে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে এনআইডি দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাতের ভোটের আয়োজনে তার সংশ্লিষ্টতা ও বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম সংক্রান্ত তথ্য দুদকের কাছে রয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রয়োজনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন রোহিঙ্গা ডাকাত নুর আলম। এ সময় তার কাছ থেকে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রের স্মার্টকার্ড পায় পুলিশ, যা ইস্যু করা হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয় থেকে।
ওই সময় অর্থের বিনিময়ে নুর ওই এনআইডি সংগ্রহ করেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে অনুসন্ধানে নামে দুদক। সেই সময় এই অনিয়মের সঙ্গে সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের নাম আসেনি। রোহিঙ্গাদের জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে এনআইডি প্রদানে তৎকালীন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা পায় দুদক। ২০২১ সালের ১৭ জুন ১৩ জন রোহিঙ্গা, এক পুলিশ কর্মকর্তা ও তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ওই মামলার বাদী ছিলেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক শরিফ উদ্দিন। পরে চাকরি হারাতে হয়েছিল শরিফ উদ্দিনকে।
এসএম/এমএমএআর/এমএস