যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার আবেদনেই তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন!

6 hours ago 3
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেনের গবেষণা প্রতিবেদনে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে উল্লেখ করে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। এ ঘটনায় ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উল্টো ওই শিক্ষকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

রোববার (১৬ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়ার আদেশে তদন্ত কমিটি গঠনের একটি নোটিশ জারি করা হয়। নোটিশটি দেখে যে কেউ স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ছাড়াই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আলোচনার জন্ম দিলে এদিনই দ্বিতীয়বার আরও একটি সংশোধিত নোটিশ জারি করা হয়।

নোটিশ দুটি জাগো নিউজের হাতে এসেছে। এতে সই করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (সংস্থাপন)।

প্রথম আদেশনামায় বলা হয়, পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর মো. ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিয়ে জাতীয় সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে সম্মানহানি করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে বিচার করার লক্ষ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার আবেদনেই তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন!

কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান সরকারকে সভাপতি, লাইব্রেরিয়ান (ভারপ্রাপ্ত) বোরহান উদ্দীনকে সদস্যসচিব এবং ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মতিউর রহমানকে সদস্য করে এই তদন্ত কমিটি করা হয়।

এমন নোটিশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ছাড়াই অধ্যাপক ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করায় সন্দেহের দানা বাঁধে। অবাক হন সংবাদ প্রকাশ করা বাকৃবির সাংবাদিকরাও। তারা পড়ালেখার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতা করছেন। সংবাদ প্রকাশের কারণে হেনস্তার শিকার হওয়ার আশঙ্কা তাদের।

উপাচার্যের আদেশে এমন নোটিশ জারির সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা তুঙ্গে ওঠায় ওইদিনই ওই আদেশনামা সংশোধন করা হয়। সংশোধন করা দ্বিতীয় আদেশনামাতেও অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান সরকারকে তদন্ত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। বোরহান উদ্দীনকে সদস্যসচিব এবং অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মতিউর রহমানকে সদস্য করা হয়েছে।

সংশোধিত এই নোটিশে বলা হয়েছে, অধ্যাপক ড. ইলিয়াস হোসেন আবেদন করেছেন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতেই জাতীয় সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদের সঠিক তথ্য উদঘাটন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ প্রদান করার লক্ষ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো।

ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধ্যাপক ড. ইলিয়াস হোসেন তার গবেষণা প্রতিবেদনে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে ইলিয়াসের বিরুদ্ধেই তদন্ত কমিটি গঠন করার দরকার ছিল। অথচ ইলিয়াস হোসেনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের সদিচ্ছা থাকলে নিশ্চয়ই যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তার আবেদনের প্রয়োজন হতো না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্ব-উদ্যোগে তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারতো।

এরআগে গত ৪ মার্চ ‘মিথ্যা তথ্যে বাকৃবি অধ্যাপকের গবেষণা, জানা গেল বছর পরে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে জাগো নিউজ। একই সংবাদ প্রকাশিত হয় আরও কয়েকটি গণমাধ্যমে।

জাগো নিউজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইলিয়াস হোসেনের গবেষণা প্রতিবেদনে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) অর্থায়নে পরিচালিত এ গবেষণায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসেসিং প্ল্যান্ট স্থাপনের তথ্য দিলেও ক্যাম্পাসে এমন কোনো প্ল্যান্টের অস্তিত্ব নেই বলে জানা গেছে।

যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার আবেদনেই তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন!

২০২৪ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত বাউরেসের বার্ষিক কর্মশালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি খামারে প্রসেসিং প্ল্যান্ট স্থাপনের তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন অধ্যাপক ইলিয়াস হোসেন।

বাউরেসের কর্মশালার প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে তখন ইলিয়াস হোসেন জানান, প্রকল্পের কার্যক্রম দুটি ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। প্রথমত, ময়মনসিংহের স্থানীয় বাজারে পোলট্রি জবাই এলাকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা এবং স্থানীয় বাজার ও প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট থেকে উৎপাদিত মুরগির মাংসের জীবাণু গুণাগুণ মূল্যায়ন করা। দ্বিতীয়ত, বাকৃবির পোলট্রি খামারে একটি মিনি প্রসেসিং প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছিল। সেই খামারে ১৫০ বর্গফুটের একটি খোলা-পার্শ্বযুক্ত প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

অধ্যাপক ইলিয়াসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেই মিনি প্রসেসিং প্ল্যান্ট গতবছর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তবে জাগো নিউজের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি সরেজমিন দেখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি খামারে সম্পূর্ণ কোনো প্রসেসিং প্ল্যান্ট নেই। সেখানে ছাদ ও দেওয়ালবিহীন একটি কাঠামো রয়েছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়।

সূত্র জানায়, বাকৃবির নানা ঘটনা, উদ্ভাবন, সফলতাসহ অনিয়ম ও দুর্নীতির রিপোর্ট বিভিন্ন সময় প্রকাশ করেছেন সাংবাদিকরা। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কারও বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে তদন্ত শেষে প্রতিবেদনে কী উল্লেখ করা হয় তা সাংবাদিকরা খোঁজ নিলেও জানানো হয় না। অভিযোগ রয়েছে তদন্তের পর ধামাচাপা থাকে প্রতিবেদন। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা কিংবা উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন উল্লেখযোগ্য কোনো নজির নেই। তাই পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইলিয়াস হোসেনের গবেষণা প্রতিবেদনে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহের দানা বেঁধেছে। সাংবাদিকদের প্রকাশিত সংবাদ মিথ্যা প্রমাণিত করতেও চেষ্টা করা হতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।

এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উপাচার্য ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়ার সাথে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, তদন্ত কমিটির তদন্ত চলছে।

একইদিন দুই রকম আদেশনামা জারি করাসহ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্তের কারণে সাংবাদিকরা কোনো অসুবিধায় পড়বে না। তবে পুরো বিষয়টি ভালো বলতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল হক।’

যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার আবেদনেই তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন!

পরে অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল হকের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন উপাচার্য। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। সত্য উদঘাটনের জন্য তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। সাংবাদিকরা কোনো অসুবিধায় পড়লে আমাকে জানাতে পারেন। আমি বিষয়টি দেখবো।’

বক্তব্য জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ও তদন্ত কমিটি সভাপতি ড. মো. আসাদুজ্জামান সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংবাদ প্রকাশের আগের দিন সাংবাদিকরা ইলিয়াস হোসেনের বক্তব্য নিতে কল দিয়েছিল। ইলিয়াস হোসেন তখন ঢাকায় ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পরদিন বাকৃবিতে এসে বিস্তারিত জানাবেন। কিন্তু সাংবাদিকরা তাকে সে সময়টুকু না দিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এছাড়া সংবাদে উল্লেখ করা তথ্যে কিছু গড়মিল থাকতে পারে, সেগুলোও তদন্ত করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ওরা সাংবাদিকতা করলেও সরাসরি আমাদের ছাত্র। আমরা তাদের অভিভাবকতুল্য। তদন্তের স্বার্থে তাদের ডেকে এনে বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে। গবেষণা প্রতিবেদনে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ ওঠা অধ্যাপক ইলিয়াস হোসেনের সঙ্গেও কথা বলছি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’

যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই তদন্ত কমিটি গঠন ঠিক হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সভাপতি আসাদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘উপাচার্য স্যারের আদেশই এই কমিটি হয়েছে। এ নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’

এসআর/এএসএম

Read Entire Article