স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত চরবেষ্টিত ৭ ইউনিয়নের লাখো মানুষ

12 hours ago 3
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা সদর থেকে নৌপথে এক ঘণ্টার যাত্রা। এরপর ঘোড়ার গাড়িতে আরও একঘণ্টার যাত্রা শেষে আজিমনগর ইউনিয়নের এনায়েতপুর। দূর থেকে চোখ পড়ে নারী-পুরুষের জটলা। কাছে গিয়ে জানা যায়, এটি প্যানেল চেয়ারম্যানের বাড়ি। বেসরকারি উদ্যোগে একজন এমবিবিএস ডাক্তার এসেছেন। ওনাকে ঘিরেই এ ভিড়।

স্থানীয়দের দাবি, ওই এলাকায় এর আগে এমবিবিএস ডাক্তার আসেনি। হিউম্যান সেফটি ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা এখানে প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার আনলো। তাই তাকে ঘিরে এত আগ্রহ। হরিরামপুরের আজিমনগর, লেছড়াগঞ্জ ও সুতালড়ি ইউনিয়ন এবং ফরিদপুরের চরভদ্রাসন ও সদর উপজেলার চারটি ইউনিয়নসহ মোট সাতটি ইউনিয়নের এই চরের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত।

ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার দুটি ইউনিয়ন- একটি চর ঝাউকান্দা, আরেকটি চর হরিরামপুর। এর মধ্যে চর হরিরামপুর ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক আছে। অন্যটিতে নেই। সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল, ডিগ্রির চর- দুটি ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। তবে সারাদেশের মতো এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবাদাতাদের বেতন বন্ধ। ওষুধ সরবরাহও নেই। যে কারণে বেশিরভাগ ক্লিনিকে সেবা নেই বললেই চলে। দুর্গম চরে তো অবস্থা আরও খারাপ।

কিছুদিন আগে আমার জায়ের ডেলিভারির সময়ও ঝামেলা হয়েছে। বাচ্চা হওয়ার পর রক্ত যাওয়া থামে না। পরে বাচ্চা রেখে মাকে ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনতে হয়েছে। আল্লাহ তাকে বাঁচাইছে। কিন্তু এরকম হলে বাঁচে না।-চারবাসী সাফিয়া বেগম

চিকিৎসার জন্য ঘোড়ার গাড়ি ও ট্রলারে চেপে যেতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগে হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা ফরিদপুরে। গর্ভবর্তী নারী ও সাপে কাটা অনেক রোগী পথেই মারা যায়। অনেক ছোটো-খাটো রোগ বিনা চিকিৎসায় থেকে যায়। চিকিৎসার ব্যয়ের চেয়ে যাতায়াত ব্যয় ও সময় বেশি লাগে। দারিদ্র্যপীড়িত জীবনে সময়ের অনেক গুরুত্ব। কাজ না করলে তো খাবার জোটে না।

চিকিৎসা নিতে আসা আজিমনগর ইউপির এনায়েতপুর গ্রামের লাইলী বেগম (৫৫) জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে কোনো ডাক্তার আসে না। চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ বা ঢাকায় যাইতে হয়। যাইতে যাইতেই আমাগো রোগী মরা হারা (মরে যায়)। এই মোড়াও নদী ওই মোড়াও নদী (দুই দিকেই নদী)। রোগী একটু ভালো থাকলে মোটরসাইকেল দিয়ে নিয়ে ট্রলারে পার হই। আর বেশি খারাপ হলে ঘোড়ার গাড়িতে নিই। যাইতে যাইতে এই বছরে অনেকে মারা গেছে। বেশিরভাগ গর্ভবতী নারী বা সাপে কাটা রোগী মারা যায়।’

নিজের মেয়ের মৃত্যুর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আট বছর আগে আমার মেয়েই ডেলিভারির সময় মারা গেছে। ডেলিভারি হয়েছে, কিন্তু রক্ত যাওয়া বন্ধ হয়নি। পরে বাচ্চাটা ঘরে রেখে মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পথেই মারা গেছে।’ নাতনিকে দেখিয়ে লাইলী বেগম বলেন, ‘এ আমার বড় মেয়ে হাওয়ার ঘরের নাতনি, তাকে রেখেই মারা যায় মেয়ে।’

একই গ্রামের সাফিয়া বেগম নামের আরেকজন বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমার জায়ের ডেলিভারির সময়ও ঝামেলা হয়েছে। বাচ্চা হওয়ার পর রক্ত যাওয়া থামে না। পরে বাচ্চা রেখে মাকে ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনতে হয়েছে। আল্লাহ তাকে বাঁচাইছে। কিন্তু এরকম হলে বাঁচে না।’

রাস্তাঘাটও ভালো না বলে জানান তিনি। চরে আমরা হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু কোনো হাসপাতাল নেই। ডাক্তার নেই। দুদিকে নদী। নদী পার হতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে। আবার নদীর পার যেতেও মোটরসাইকেল বা ঘোড়ার গাড়িতে যেতে হয়। সময় লাগে অনেক। ওই নারী বলেন, খাওয়া-দাওয়ায় কষ্ট নেই, বসবাসেও কষ্ট নেই। কষ্ট শুধু চিকিৎসা ও শিক্ষায়।

এখানে আমরা মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে চিকিৎসাসেবা দিই। প্রতিদিন একেকটা ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা দিই। এটা পদ্মা নদীর ভাঙনপ্রবণ এলাকা। এখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। খুবই রিমোট এরিয়া, ওনারা হাসপাতালে যেতে পারেন না। হাসপাতালে যাওয়া তো দূরে থাক, তাদরে জন্য যাতায়াত করাই কঠিন।–হিউম্যান সেফটি ফাউন্ডেশনের (এইচএসএফ) চিকিৎসক ডা. আব্দুল করিম

রাজিয়া নামে আরেক রোগী জানান, এই এলাকায় এমবিবিএস ডাক্তার পান না তারা। ফরিদপুর বা মানিকগঞ্জ যাওয়া লাগে। এখানে ডাক্তার আসছে শুনে দেখাতে এসেছেন। প্রেসার বেশি এবং ব্যথার সমস্যা। চিকিৎসাপত্রও পেয়েছেন। তবে ওষুধ দিলে আরও ভালো হতো বলে মত তার।

হিউম্যান সেফটি ফাউন্ডেশনের (এইচএসএফ) চিকিৎসক ডা. আব্দুল করিম বলেন, ‘এখানে আমরা মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে চিকিৎসাসেবা দিই। প্রতিদিন একেকটা ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা দিই। এটা পদ্মা নদীর ভাঙনপ্রবণ এলাকা। এখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। খুবই রিমোট এরিয়া, ওনারা হাসপাতালে যেতে পারেন না। হাসপাতালে যাওয়া তো দূরে থাক, তাদরে জন্য যাতায়াত করাই কঠিন।’

স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত চরবেষ্টিত ৭ ইউনিয়নের লাখো মানুষ

তিনি বলেন, ‘সুবিধাবঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীর জন্য আমরা স্বাস্থ্যসেবা দিই। প্রতিদিন ৬০/৭০ জন রোগী থাকে। অনেক দিন ১০০ এর বেশি রোগী হয়। বেশিরভাগ মেডিসিন ও স্কিনের রোগী পাই। বাত ব্যথা, রিউমোটোলজি ও রেসপেরেটোরি মেডিসিনের রোগী বেশি পাই। আমরা প্রাথমিকব স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পর জটিলতা থাকলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা জেলা হাসপাতালে রেফার করি।’

এই চিকিৎসক বলেন, ‘চর এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। কমিউনিটি ক্লিনিক জনবলের অভাবে তেমন খোলা হয় না বা ওষুধ বিতরণও হয় না। এত বড় এলাকায় একজনও চিকিৎসকও আসে না। যার জন্য এই রোগীদের পদ্মা নদী পার হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়। তাতে সময় ও অর্থ ব্যয় বেশি হয়। কোনোভাবে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করলে এলাকার উন্নতি হবে, মানুষের উপকার হবে।’

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানিকগঞ্জ ও ফরিদপুরের অংশ মিলে আমাদের এই চরে লাখ তিনেক মানুষের বসবাস। এখানে ৫০ শয্যার একটা হাসপাতাল হলে মানুষের কষ্ট লাঘব হতো। বিশেষ করে, আমাদের সন্তানসম্ভবা নারী ও সাপে কাটা রোগীদের অকাল মৃত্যু হতো না। উভয় জেলার প্রশাসন ও দেশের সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ। তারা যদি একটা হাসপাতাল করে দেয়, আমরা উপকৃত হবো।’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি প্যানেল চেয়ারম্যান (চেয়ারম্যানের দায়িত্বে) মো. জাহাঙ্গীর শিকদার বলেন, ‘আমাদের এলাকার স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা খুবই দুর্বল। কারণ, এখানে কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক, হাসপাতাল বা চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র নেই। আমাদের এলাকার একটা মহিলার প্রসব বেদনা উঠলে হাসপাতালে নিতে হলে একপাশে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর আরেক পাশে ফরিদপুর নিতে হয়। আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ আছে, সবকিছুই ঠিক আছে। একটা হাসপাতাল পাইলেই হয়। চর এলাকায় নারী ও শিশু মারা যায় বেশি। সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ যাতে তারা আমাদের চরের দিকে নজর দেয়।’

আমাদের এলাকার স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা খুবই দুর্বল। কারণ, এখানে কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক, হাসপাতাল বা চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র নেই। আমাদের এলাকার একটা মহিলার প্রসব বেদনা উঠলে হাসপাতালে নিতে হলে একপাশে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর আরেক পাশে ফরিদপুর নিতে হয়। সবকিছুই ঠিক আছে, একটা হাসপাতাল পাইলেই হয়।- স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মো. জাহাঙ্গীর শিকদার

হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কাজী একেএম রাসেল বলেন, ‘আজিমনগর ও সুতালড়ি ইউনিয়নে আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। তবে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক এবং সাব সেন্টার আছে। আমরা কাজ করি। পরিবার পরিকল্পনা অফিসও কাজ করে। এমন নয় যে, তারা একেবারেই স্বাস্থ্যসেবা পায় না।’

তবে তিনি দাবি করেন, ‘মারা যাওয়ার ঘটনা নেই। মাতৃমৃত্যু নেই। তবে যাতায়াত একটা সমস্যা আছে। চরাঞ্চল এমনিতে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং যাতায়াতে একটু পিছিয়ে আছে। আজিমনগর ইউনিয়নের বিষয়টি আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। দেখি কী সিদ্ধান্ত আসে।’

এ বিষয়ে হিউম্যান সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এম এ মুকিত জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে মানিকগঞ্জের প্রজেক্টটি ২০২৩ এর জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত আমরা সেখানে ২৫ হাজার ১৪ জন রোগীর স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছি। এর মধ্যে নারী ১৭ হাজার ৩৬০ জন এবং শিশু দুই হাজার ৪৬১ জন।’

তিনি বলেন, শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, হরিরামপুরের অবহেলিত ওই চরাঞ্চলে আমরা মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি সেনেটারি ন্যাপকিন দিই। স্কুলে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে আমাদের বক্স রাখা আছে। যে কেউ নিতে পারবে। পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় চরে আমরা বৃক্ষরোপণের কাজও করি।’

এসইউজে/এএসএ/এএসএম

Read Entire Article