রোজার পূর্ণতার জন্য চোখের হিফাজত জরুরি

6 hours ago 4
ARTICLE AD
468x60 AD AFTER 4 POSTS

বছর ঘুরে মাহে রমাযানের জন্য সাহাবায়ে কিরাম রা. উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। এ মাস থেকে সর্বোচ্চ অর্জনের জন্য তাঁদের যারপর নাই প্রচেষ্টা থাকতো সর্বদা। রাসূলও সা. তাদেরকে জানিয়েছেন কীভাবে প্রত্যাশা সাথে প্রপ্তির মিল করা যায়। কোনভাবেই যেন রোজা সামান্য ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেই পথ বাতলে দিয়েছেন তিনি। 

আবু হোরায়রা রা. এক বর্ণনায় বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, রোজা হলো ঢাল স্বরূপ। যতক্ষণ না তোমরা তাকে ছিদ্র করে ফেলো। কেউ জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস সেটাকে ফুটো করে দেয়? তিনি উত্তর দিলেন: মিথ্যা কথা কিংবা অন্য কোন অবাধ্যতা। (আল মু‘জামুল আওসাত: ৭৮১৪)

বিশিষ্ট সাহাবি আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবীজি সা. বলেছেন, রোজা হলো ঢাল স্বরূপ। তোমরা এটাকে ত্রুটিযুক্ত করো না, রোজাকে ভূলে যেয়ো না। কেউ যদি রোজাদারের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় অথবা তাকে গালমন্দ করে তবে সে অন্তত দুবার বলবে, আমি রোজাদার। (বোখারি)

উল্লেখিত হাদিসগুলোর বর্ণনা প্রমাণ করে রোজাকে পরিপূর্ণভাবে আদায় করতে গুনাহ ছাড়ার কোনো বিকল্প নেই। চোখ দিয়ে ইসলাম নিষিদ্ধ কোনো কিছু দেখা যাবে না, হাত দিয়ে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করা যাবে না, মুখ দিয়ে মিথ্যা বলা কিংবা ধোঁকাবাজি করা যাবে না। এক কথায় সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহমুক্ত রাখতে হবে। 

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহের সাথে সম্পৃক্ত করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে আল্লাহ তা’আলার বড় এক নেয়ামত ‘চক্ষু’। এটি ভালো কাজে যেমন উৎসাহিত করে তেমনি কারাপ পথেও ধাবিত করে। এর মূল্য ও গুরুত্ব আল্লাহ তা’আলার কাছেও অনেক বেশি। 

হযরত আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. এর ভাষায় আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন; ‘আমি যার চক্ষুদয়কে নিস্প্রভ করে দিয়েছি, অতপর সে ধৈর্য ধারণ করেছে এবং প্রতিদান প্রত্যাশা করেছে, আমি তার জন্য জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট হবো না’। (তিরমিযি)

মানব দেহে এই চোখের গুরুত্ব অনেক বেশি। দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় পঞ্চইন্দ্রীয়ের মধ্যে চোখের বিকল্প যেমন নেই তেমনি প্রভাবও সর্বাধিক। অন্যান্য ইন্দ্রীয়ের প্রভাব তৎক্ষনাৎ শেষ হয়ে গেলেও চোখের প্রভাব হয় দীর্ঘস্থায়ী। কুরতুবী রহ. বলেন: ‘চোখ হলো মানুষের অন্তরে প্রবেশের সবচেয়ে বড় দরজা’। ইমাম গাজালী রহ. বলেন, কোনো ভালো বা মন্দ মানব অন্তরে প্রবেশ করে প্রভাব সৃষ্টি করার ধারাবাহিকতা এভাবে: প্রথমে দৃষ্টিগোচর হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্তরে প্রভাব সৃষ্টি হয়। তৃতীয় পর্যায়ে কাজটি করার জন্য অন্তর পরিকল্পনা করে। চতুর্থ পর্যায়ে কাজটি করে ফেলা। অবশেষে কাজটিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। 

এ কারণে ভালো দৃষ্টি যেমন ভালো তেমনি খারাপ দৃষ্টিও অত্যন্ত খারাপ। ইসলাম এ ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল নির্দেশনা দিয়েছে। চোখের সামান্য খেয়ানতকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করেছেন: নিশ্চয় শ্রবন, দৃষ্টি ও অন্তর প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সূরা ইসরা: ৩৬) অন্য আয়াতে তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা চোখের খিয়ানত এবং তোমরা অন্তরে যা লুকিয়ে রাখ সে সম্পর্কে সম্মক জ্ঞাত। (সূরা গাফের: ১৯) অন্যত্র বলেছেন: চোখের হিফাজত করতে পারলে সেটা হবে: তোমাদের জন্য সর্বোচ্চ অন্তরের পবিত্রতা। (সূরা নূর: ৩০)

চোখের হেফাজতের জন্য করণীয়: 

১.চক্ষু অবনত রাখতে হবে। পবিত্র কুরআনের সূরা নূর এর ৩০-৩১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন: হে নবী আপনি মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের চক্ষুকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান হেফজত করে। তবে এটা তাদের অন্তরের জন্য হবে অধিক পবিত্রতা। নিশ্চয়ই তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ সাম্মক জ্ঞাত। মুমিন নারীদেরকেও আপনি বলে দিন তারাও যেন তাদের চক্ষুকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান হেফজত করে.........।

২.নিষিদ্ধ বিষয়ের দিকে নজর পড়ে গেলে দ্বিতীয়বার তাকানো যাবে না। রাসূলুল্লাহ সা. হযরত আলী রা. কে বলেন: নিষিদ্ধ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি পড়ে গেলে তুমি চোখকে ঘুরিয়ে নিবে, দ্বিতীয়বার তাকাবে না। কেননা প্রথম বার তোমাকে ছাড় দেয়া হবে, দ্বিতীয়বার নয়। (আবু দাউদ)

৩.দৃষ্টির খিয়ানত হতে পারে এমন কাজ থেকে দূরে থাকা। হযরত আবু সাঈদ খুদুরি রা. রাসূল সা. থেকে বর্ণনা করেন যে, নবীজি সা. বলেছেন, তোমরা রাস্তার ধারে বসবে না। সাহাবায়ে কিরাম রা. বললেন, হে আল্লাহর রসুল সা. আমাদেরতো প্রয়োজনে রাস্তার ধারে বসে কথাবার্তা বলতেই হয়। নবীজি সা. বললেন, যদি বস তবে তার হক আদায় করবে। সাহাবায়ে কিরাম রা. বললেন, রাস্তার হক কি? উত্তরে নবীজি সা. বললেন, ১. দৃষ্টি অবনত রাখা ২. পথের কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা ৩. সালামের উত্তর দেওয়া ৪. মানুষকে ভালো কাজের আদেশ করা এবং ৫. খারাপ কাজ করা থেকে নিষেধ করা। (বুখারি)

সাহাবায়ে কিরাম রা. নিজের চোখ হেফাজত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। কখনও খেয়ানত হয়ে গেলে সেজন্য কেঁদেছেন সারাজীবন। ইমাম আওযাাঈ রহ.  বর্ণনা করেন, কোন এক যুদ্ধে এক দাসীর কাপড় খুলে গেলে গাজওয়ান রা. এর দৃষ্টি তার দিকে পড়ল। আবু মুছা রা. বললেন: ‘তুমি তোমার চোখের প্রতি জুলুম করলে। অতএব আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও’। তিনি এমন ভাবে অনুতপ্ত হলেন যে, ইতিহাসে পাওয়া যায়, গাজওয়ান রা. মৃত্যু পর্যন্ত আর কোনোদিন হাসেননি।

চোখ দিয়ে কি করা উচিৎ: 

১. শরীয়াহ অনুমোদিত বিষয় দেখব। ২. আল্লাহর সৃষ্টি দেখে দেখে তাঁকে খোঁজার চেষ্টা করব। ৩. কুরআন, হাদিস অধ্যায়ন করব। ৪. বায়তুল্লাহ দেখব। ৫. পিতা-মাতার দিকে তাকাব। ৬. আল্লাহর প্রিয় বান্দাদেরকে দেখব। ৭. আল্লাহর ভয়ে ও মুহাব্বতে চোঁখ দিয়ে অশ্রু ঝরাব। 
 এর বিনিময়ে জান্নাত পাওয়া যাবে, আরশের নিচে ছায়া পাওয়া যাবে। 

হযরত আব্বাস রা. বলেন, আমি রাসুল সা. কে বলতে শুনেছি, রাসুল সা. বলেছেন: দুই ধরনের চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। ১. যে চোখ আল্লাহর ভয়ে অশ্রু ঝড়ায় ২. যে চক্ষু আল্লাহর রাস্তায় জাগ্রত থেকে পাহারা দেয়। (তিরমিযি)

উম্মুল মুমিনিন সাইয়্যেদা হাফসা রা. বলেন, আমি আমার বাবা উমর রা. এর ঘরে ছিলাম। ইত্যবসরে নবি কারীম সা. সেখানে এলেন। কথা-বার্তায় দেরি হয়ে গেলো। এজন্য সিদ্ধান্ত নিলেন, আজকের রাত এখানেই কাটিয়ে দেবেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আমার পাশে একই বিছানা ঘুমিয়ে পড়লেন। হাফসা রা. বলেন, গভীর রাতে আমি অনুভব করলাম- আমার গালে গরম কিছু একটা স্পর্শ করল। মনোযোগের সঙ্গে ভাবতেই বুঝতে পারলাম, সেটি কারো অশ্রুর উষ্ণতা। আমি শোয়া থেকে ওঠে বসলাম। আমরা দুজনে যেহেতু একটি বালিশের ওপরই মাথা রেখে ঘুমিয়েছি; এজন্যে বুঝতে পারলাম, নবি করীম সা. চোখ মুবারক থেকে প্রবাহিত অশ্রু বালিশের ওপর পড়ছে। সেই অশ্রুর কারণে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। আমি আতঙ্ক জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম- হে আল্লাহর রাসল সা.! কী কারণে আপনার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে?' বললেন, তুমি কি শোনোনি, তোমার ভাই বারান্দায় তাহাজ্জুদের নামায পড়ছে। এই মাত্র সে কোন আয়াতটি পড়ছে? হাফসা রা. বলেন, আমি মনোযোগ নিবদ্ধ করলাম। বুঝতে পেলাম, ভাইয়া এখন তাহাজ্জুদের মাঝে এ আয়াতটি পড়ছেন-

‘কখনও না, তারা সেদিন তাদের পালনকর্তার থেকে পর্দার অন্তরালে থাকবে’ (সূরা মুতাফ্ফিীন: ১৫) অর্থাৎ সেদিন তারা আল্লাহর সাক্ষাত পাবে না। এ আয়াত শুনে নবী করীম সা. এর চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগলো যে, কতই না হতভাগা তারা, যারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর দিদার থেকে বঞ্চিত হবে।

অতএব, আসুন আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই যেন কোনোভাবেই আমাদের চোখের খিয়ানত না হয়। আমাদের রোজা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও ব্যাপক সাধনা থাকলে আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই আমাদেরকে সহজ করে দিবেন। আমরা যদি গুনাহের ক্ষতির কথা সর্বদা মনে রাখতে পারি তবেই আমাদের পক্ষে গুনাহ ছেড়ে দেওয়া সহজ হবে। মনে রাখতে হবে, চোখের খিয়ানত শুধু রোজায় নয় সব সময়ই হারাম। আল্লাহ সহায় হোন, আমিন।

লেখক: প্রিন্সিপাল ও মুহাদ্দিস, জামিয়া সাঈদিয়া কারীমিয়া, সাঈদনগর, ভাটারা ঢাকা।

Read Entire Article